বেশ কয়েকদফা সময় বাড়িয়েও শেষ করা যায়নি কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ভবন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ। এতে চটেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কেন সময় মতো কাজ শেষ হয়নি তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন।
এরপর নড়েচেড়ে বসেছেন সবাই। তবে অতীতের দুই প্রকৌশলীর অপকর্ম আর সমন্বয়হীনতার ফলেই ডুবেছে জনগুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্প, এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।
জানা গেছে, ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ২০১১ সালে মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট টেনিং ইনস্টিটিউট (ম্যাটস) ভবনে অস্থায়ী ভাবে যাত্রা শুরু হয় কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের। আর ২০১৩ সালে শহরের লাহেনী এলাকায় ২০ একর জায়গার ওপর ২৭৫ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরে নির্মাণ শুরু হয় কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ভবন প্রকল্পের কাজ। প্রকল্পটি ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আজও শেষ হয়নি এ প্রকল্পের কাজ।
এ প্রকল্পের কাজ সময় মত শেষ না হওয়ায় সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একনেকের বৈঠক অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।
মেডিকেল কলেজের একাধিক সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে প্রকল্পের যে কাজ শুরু হয় তার ডিপিডি করা তৈরি করা হয় ২০০৮ সালে । সব কার্যক্রম শেষে যখন কাজ শুরু হয় তখন সব কিছুর বাজার দর বেড়ে যায়। তাই নকশা অনুয়ায়ী প্রতিটি ভবন শেষ না হলেও বরাদ্দকৃত অর্থ ফুরিয়ে যায়। সে সময় পরিদর্শনে এসে আইএমইডির টিমের সদস্যরা অনিয়মের অভিযোগ এনে প্রতিবেদন দেন। এতে প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে গণপুর্তের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ কয়েকজনকে সরিয়ে দেয়া হয়।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, ‘২০১২ সালে যখন টেন্ডার আহ্বান করা হয় তখন কুষ্টিয়া গণপূর্তে নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন শাহিন মিয়া।তিনি তার সময় এক সাথে ৬টি ভবনের টেন্ডার করেন। টেন্ডার শেষে কাজ শুরু না হতেই অগ্রিম বিল দিয়ে দেন ঠিকাদারদের। ঠিকাদাররা অগ্রীম বিল পেলেও কাজ শুরু করেন আরো পরে। অভিযোগ আছে, এ জন্য ঠিকাদারদের কাছ থেকে তিনি ৫ কোটির বেশি কমিশন নিয়ে ঢাকায় পোষ্টিং নেন।
এরপর যোগদেন মোহাম্মদ শহিদ কবির। তিনি দায়িত্বে ছিলেন কয়েক বছর। তিনিও যোগ দিয়ে কমিশন বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। ঠিকাদারদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে হাতিয়ে নেন কোটি টাকা। এই দুই প্রকৌশলী ডিপিপি ক্রয় পরিকল্পনার ব্যতয় ঘটিয়ে কোটি কোটি টাকার লিমিটেড (এলটিএম) টেন্ডার করেন। ক্রয় পরিকল্পনায় ছিল প্রতিযোগিতা মূলক দরপত্র আহ্বান বা ওপেন (ওটিম) টেন্ডার। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ঠিকাদার নির্ধারণ করার কথা বলা হলেও এ প্রকৌশলীরা তা না করে যোগসাজসে লিমিটেড টেন্ডার করেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে।
এতে করে সরকারের খরচ বৃদ্ধি ও কোটি কোটি টাকা অপচয় হয়। তারাও হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকার অর্থ।
সে সময় কাজের ধীরগতি ও যে বাজেট দেয়া হয় তা দিয়ে কাজ পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। ৬ তলা ভবনের জন্য যে বাজেট দেয়া হয়েছিল তা দিয়ে নির্মাণ করা হয় ৪ তলা ভবন। তবে বিষয়টি গোপন রাখে তখনকার কয়েকজন প্রকৌশলী। বিষয়টি সরকারের দপ্তর আইএমইডির নজরে আনার কথা থাকলেও তা না করে কাজ চালিয়ে যায় ঠিকাদার ও প্রকৌশলীরা। এরপর আপত্তি দেয় পরিদর্শন করতে আসা। তারা অনিয়ম ও অদক্ষতা এবং নির্বাহী প্রকৌশলীদের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
এরপর দুই বছর তদন্তে কেটে যায়। অর্থ ছাড়ও বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৮ সালে নতুন করে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি অর্থ ছাড় করা হয়। সে সময় কাজ তদারকির দায়িত্বে আছেন মানিক লাল দাস। তিনি গণপূর্ত যশোর সার্কেলের তত্বাবধায়ক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এ কাজের সাথে থাকলেও সাইড পরিদর্শনে আসেননি ঠিক মতো। এরই মধ্যে একটি ভবনের নির্মানাধীন ছাদ ধসে পড়ে। এতে তাতে তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মানিক লাল দাসের অবেহলা ছিল বলে ধরা পড়ে।
তবে অন্যরা শাস্তি পেলেও তিনি পার পেয়ে যান অর্থের জোরে। তার বিরুদ্ধে মেডিকেলের ঠিকাদারদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার মত অভিযোগ আছে।
অনিয়মের বিষয়ে মানিক লাল দাস বলেন, সব অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। সব কাজ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে জানান তিনি। তিনি দ্বৈত নাগরিক নন বলেও দাবি করেন।
এসব বিষয় নিয়ে তখনকার নিবাহী প্রকৌশলী শাহিন মিয়া বলেন, তারা যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে টেন্ডার করেছিলেন। কোন অনিয়ম হয়েছে বলে আমার জানা নেই। শাহিন মিয়া পদোন্নতি পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
তবে কুষ্টিয়া গণপূর্তের বর্তমান প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম যোগ দেওয়ার পর প্রকল্পের কাজে গতি এসেছে। জানা গেছে, বিগত ৬ বছরে প্রকল্পের মাত্র ৩০ ভাগ কাজ শেষ হয়। আর প্রকৌশলী আরিফুল ইসলামের সময় প্রকল্পের প্রায় ৬০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ভবনের পিডি ডা. আমিনুল ইসলাম বলেন,‘ নতুন করে জমি অধিগ্রহণ ও আরো কিছু ভবন নির্মাণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আর আগের যেসব কাজ চলমান তা শেষের পথে। নতুন বছরেই নতুন ক্যাম্পাসে সব কার্যক্রম শুরু হবে বলে আমরা আশা করছি।
কুষ্টিয়া গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম বলেন, গত দেড় বছরে চেষ্টা করেছি কাজের মান শতভাগ ঠিক রেখে দ্রুত কাজ শেষ করতে। আমার সময়ে বেশির ভাগ শেষ হয়েছে। অনেক ভবন ব্যবহার উপযোগী করা হয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়েছে।