বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ, তার অঙ্গসংগঠন যুবলীগ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে কানাডায় ২০১৯ সালের মার্চে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় চান বুরহান উদ্দিন শিকদার মাসুদ নামে একজন বাংলাদেশি। তবে তার শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় চাওয়ার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিল কানাডার শরণার্থী সুরক্ষা বিভাগ (আরপিডি)। অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকায় সেটি প্রত্যাখান করা হয়। সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করলেও মাসুদ আদালতকে যথাযথ প্রমাণ দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় কানাডার ফেডারেল আদালত তা খারিজ করে দিয়েছেন। গত ১২ অক্টোবর মামলা খারিজ করে রায় প্রকাশ করে কানাডার ফেডারেল আদালত।
মামলার রায়ে বলা হয়, বুরহান উদ্দিন শিকদার মাসুদের অভিযোগগুলো বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করেনি আরপিডি। যার প্রেক্ষিতে মাসুদ শরণার্থী আপিল বিভাগে (আরএডি) আবেদন করেন। আপিল করার পরে, তিনি তার পক্ষে নতুন প্রমাণ দাখিল করার চেষ্টা করেছিলেন। আরপিডির তদন্তকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন মাসুদ। আরএডি নতুন প্রমাণ গ্রহণ করেনি কারণ সেগুলো বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি এবং আপিলটি খারিজ করে দেওয়া হয়।
ফেডারেল আদালতের নথিতে বলা হয়, মাসুদ তার আপিল খারিজের বিরুদ্ধে বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনার বিষয়ে বেশ কয়েকটি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। এগুলোকে তিনটি বিভাগে বিভক্ত করা যেতে পার- মূল নথিগুলো দেখার জন্য আরএডির অনুরোধের ন্যায্যতা; নতুন প্রমাণ গ্রহণ না করার এবং মৌখিক শুনানি না করার আরএডির সিদ্ধান্তের চ্যালেঞ্জ এবং আরএডির বিশ্বাসযোগ্যতার তদন্তের চ্যালেঞ্জ।
কানাডার ফেদারেল আদালতের বিচারক সাদ্রেহাশেমী রায়ে বলেন, ‘মাসুদ আমাকে সন্তুষ্ট করেননি যে আরএডির প্রক্রিয়াটি অন্যায্য ছিল বা নতুন প্রমাণ এবং বিশ্বাসযোগ্যতার উপর এর মূল অনুসন্ধানগুলো অযৌক্তিক। প্রাপ্তকারণগুলোর উপর ভিত্তি করে, আমি বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার আবেদনটি খারিজ করে দিচ্ছি।
রায়ে বলা হয়, মাসুদ বাংলাদেশের নাগরিক। তার অভিযোগ, তার বাবা-মা ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তার মায়ের বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে সমাবেশ আয়োজনে জড়িত ছিলেন। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মাসুদ অভিযোগ করেন যে, আওয়ামী লীগ তার পিতামাতার বিরুদ্ধে বিএনপি সমর্থন এবং সরকার বিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেছে। মাসুদ বলেন, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তার বাবা আওয়ামী লীগকে দাবি করা টাকা দিতে অস্বীকার করায় তার ওপর হামলা চালানো হয় ‘
এর পরের মাসে মাসুদ স্টুডেন্ট ভিসায় কানাডায় আসেন। কানাডায় আসার পর থেকে তার বাবা-মাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, তার বাবাকে অপহরণ করা হয়েছে এবং যুবলীগের সদস্যরা তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছে। মাসুদ আরও দাবি করেছেন যে, পুলিশ তার মাকে ডেকে নিয়ে তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।
মাসুদ ২০১৯ সালের মার্চ মাসে কানাডায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দাবি করেছিলেন। ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তার শরণার্থী দাবির শুনানি হয়। শুনানির পরে, আরপিডি পুলিশ এবং আদালতের নথিগুলোর মূল কপি দেখতে চাওয়া হয়। তবে তদন্তে সেই মূল কপিগুলো কম্পিউটারে এডিট করে বানানো বলে মনে হয়। যার ফলে আরও প্রমাণ এবং এই সংক্রান্ত নথি তার কাছে চাওয়া হয়। মাসুদ আরপিডিকে মূল তথ্য সরবরাহ করেছিলেন এবং এই বিষয়ে আরও প্রমাণ এবং উপস্থাপনা দাখিল করেছিলেন। আরপিডি ২০২১ সালের জুনে তার শরণার্থী আশ্রয় দাবি প্রত্যাখ্যান করে। কারণ তার সরবরাহ করা পুলিশ এবং আদালতের রেকর্ডগুলো জালিয়াতি বলে মনে করে আরপিডি এবং শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, মাসুদের অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য নয়।
এরপর ২০২১ সালের জুন মাসে মাসুদ আরপিডির বাতিল করা আবেদনের বিরুদ্ধে একটি আপিল আরএডি’র কাছে দায়ের করেন। মাসুদের আইনজীবী নতুন প্রমাণ এবং আপিলের উপর আইনী উপস্থাপনের জন্য অতিরিক্ত সময়ের জন্য বেশ কয়েকটি অনুরোধ করেছিলেন। আরএডি এই অনুরোধগুলো মঞ্জুর করেছে। আরপিডির মতো, আরএডি প্রাথমিকভাবে আরপিডিতে জমা দেওয়া কিছু নথির মূল এবং আরএডিতে দায়ের করা নতুন প্রমাণের মূল কাগজ দেখার জন্য অনুরোধ করেছিল। তবে আপিলের সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে মাসুদ কোন মূল কাগজ জমা দেননি।
আরএডি ২০২২ সালের ২১ শে মার্চ আপিলটি খারিজ করে দেয়। আরপিডির মতো, আরএডি দেখতে পেয়েছে যে মাসুদ তার দাবি প্রমাণ করতে জালনথি জমা দিয়েছিলেন।
সর্বপ্রথম ২০১৭ সালে মোহাম্মাদ জুয়েল হোসেন গাজী নামে ঢাকার মিরপুরের স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন কর্মীর কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন নাকচ হওয়ার পর কানাডার ফেডারেল কোর্টে রিভিউর আবেদনে বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলা হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বিএনপির কর্মী হিসেবে মো. মোস্তফা কামাল নামে এক ব্যক্তি আশ্রয় চাইলে দ্বিতীয় দফায় বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। একই বছরের অক্টোবরে মাসুদ রানা এরপর ২০২২ সালে ছাত্রদল কর্মী সেলিম বাদশার অভিবাসন নাকচ করার সময়ও বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন উল্লেখ করেন কানাডার আদালত।
সর্বশেষ গত ১৫ জুন মোহাম্মদ জিপসেদ ইবনে হক নামে এক বিএনপিকর্মী কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করলে তা নাকচ করে দেন দেশটির ফেডারেল কোর্ট। রায়ে উল্লেখ করা হয়, ওই ব্যক্তি এমন দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যেই সংগঠন বল প্রয়োগ এবং সন্ত্রাসের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাতের চেষ্টা করছে। রিভিউর আবেদন নিষ্পত্তিকালে আদালতের বিচারক বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করেন।