বাংলাদেশের রোভার স্কাউট সদস্যদের কাছে একটি শোকাবহ দিন । ১৯৯৭ সালের ২৩ শে অক্টোবর দিনটি ছিলো রোভার লিডার এবং রোভার স্কাউটস সদস্যদের সবার কাছে একটি স্বপ্নের দিন । সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগানে ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত ৯ম এশিয়া প্যাসিফিক ও ৭ম বাংলাদেশ রোভার মুট এ অংশগ্রহন করার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল মেহেরপুর জেলা রোভার । জেলা রোভার থেকে ৪ টি টিমে ৩৬ জন সদস্য রোভার মুটে অংশগ্রহনের জন্য মেহেরপুর জেলার রোভাররা আনন্দের প্রহর গুনতেছিল আর সেই সাথে রোমাঞ্চকর এক অধ্যায়ের আগমনের বার্তা অনুভব করছিলো। অবশেষে এসে গেল ১৯৯৭ সালের ২৩ শে অক্টোবরের সেই আকাঙ্ক্ষিত দিনটি।
রোভার মুটে অংশগ্রহনকারীরা বাড়ী থেকে বিদায় নিয়ে জমায়েত হয় মেহেরপুর সরকারি কলেজ চত্বরে। আনন্দঘন পরিবেশে মুটে অংশগ্রহনকারী চারটি দল মেহেরপুর সরকারি কলেজ রোভার দল, মুজিবনগর সরকারি কলেজ রোভার দল, মেহেরুল্লা মুক্ত রোভার দল, ও মুন্সি জমিরউদ্দীন মুক্ত রোভার দল উপস্থিত হলো। ১৯৯৭ সালের ২২শে অক্টোবর রাত ৯.০০ টার সময় চারটি দলের মোট আটজন করে রোভার এবং একজন রোভার নেতা সহ সবাই রিজার্ভ করা একটি মিনিবাস মেহেরপুর সরকারি কলেজ থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। ফেরীঘাটে দীর্ঘসময় যানজটে আটকে থাকার পর গাড়িটি ঘাট পার হয় তখনও রোভার সদস্যের কেউ ঘুমায়নি সারারাত আনন্দ উল্লাস করে সময় পার করছিলো। কেউ ভাবতে ও পারেনি তাদের জন্য সামনে কি ভয়াবহ এক ট্য্যজিডি অপেক্ষা করছে।
ফেরী পার হওয়ায় পর সবার চোখে তখন ঘুমের ভাব এসেছিল সেই সময় আর কোন যানজট ছিল না। ড্রাইভার গাড়ির গতি বাড়িয়ে যাচ্ছিলেন। সে সময় মেহেরপুর সরকারি কলেজের শরীরচর্চা শিক্ষক হাজী রমজান আলী ড্রাইভারকে গাড়ি ধীরে চালানোর জন্য অনুরোধ করার পরও তিনি র্কণপাত করেননি। ২৩ শে অক্টোবর ভোরে রোভারদের বহনকারী গাড়িটি ধামরাই এর জয়পুর নামক স্থানে পৌছলে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রাকের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ঘটনাস্থলেই পাঁচজন রোভার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
এই মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা সমগ্র বাংলাদেশের রোভারদের জন্য শোকাবহ হয়ে ওঠে। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় তৎকালীন মেহেরপুর সরকারি কলেজের শরীর চর্চা শিক্ষক ও রোভার লিডার রমজান আলী, মুজিবনগর কলেজের রোভার ইউনিট লিডার আনোয়ার স্যারসহ অনেকেই আহত হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুতর আহত হয় মেহেরপুর সরকারি কলেজের রোভার ফারুক হোসেন। ঘটনাস্থলে নিহত হন রোভার মোঃ মাসুম হোসেন, রোভার মোঃ মনিরুল ইসলাম, রোভার মাহফুজুর রহমান মাহফুজ, রোভার জাভেদ ওসমান, পিএস ও রোভার এস এম আমিনুল ইসলাম।
লাক্কাতুরা ক্যাম্পে যখন এ খবর পৌছায় তখন সেখানে নেমে আসে শোকের ছায়া। ২৩ তারিখ সেখানে শোক পালন করা হয়। বাংলাদেশের রোভার স্কাউটস ইতিহাসে এই দিনটি চিরদিন স্বরণীয় হয়ে থাকবে। সবচেয়ে বেশী আহত হয় ফারুক হোসেন তখন মেহেরপুর সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র এবং রোভার দলের একজন সক্রিয় সদস্য। সেদিন সম্পর্কে ফারুক বলেন, ২৩ শে অক্টোবর ভোর হবার কিছুক্ষণ আগে আমি ঘুমিয়ে যায়, যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন আমি হাসপাতালের বেডে যা পরবর্তীতে জানতে পারি ।
প্রথমে আমি কিছুই মনে করতে পারছিলাম না। পরে জানতে পারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমি দীর্ঘ ৭৫ দিন অচেতন অবস্থায় ছিলাম। আমার যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন আমার অবস্থা সদ্য ভুমিষ্ট শিশুর মতো। আমার নিজে থেকে কোন কাজ করার ক্ষমতা ছিলো না। ওঠা, বসা, খাওয়া, কথা বলা, লেখার কোন ক্ষমতা ছিলোনা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দীর্ঘ তিনমাস আমি বিছানায় কাটিয়েছি। আমার সবচেয়ে বেশী আঘাত লেগেছিল মাথাসহ বামপাশে। কানসহ অর্ধেক জায়গায় কোন চামড়া ছিলনা ।
পায়ের উরু থেকে চামড়া নিয়ে পরে সেখানে প্রতিস্থাপন করা হয়। আমি যতদিন বেচে থাকবো ততদিন আমাকে এই স্মৃতি মনে থাকবে। সেই সময় তৎকালীন মাননীয় রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ আমাকে দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছিলেন। তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন বৃটেন সফররত তিনি সেখান থেকে শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন এবং নিয়মিত খোঁজ খবর নিতেন ।
বাংলাদেশ রোভার অঞ্চলের সম্মানিত স্যাররা সবসময় আমার সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে আমার পাশে থেকে সহযোগিতা করেছেন। আমি আল্লাহর অশেষ রহমতে সকল প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে লেখাপড়া সম্পন্ন করেছি। তিনি আরও বলেন, স্কাউটস আমার প্রাণ, আমার বাঁচার অনু প্রেরণা। ফারুক হোসেন বর্তমানে মুজিবনগর উপজেলার আনন্দবাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন । তিনি ২০১৮ সালে জেলার শ্রেষ্ট শিক্ষক নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে তিনি সরকারিভাবে ভিয়েতনাম সফর করেন।
তিনি বর্তমানে কাব শাখাতে সিএএলটি সম্পন্নকারী। তিনি বর্তমানে উপজেলা কাব লিডারের দায়িত্বে আছেন। তিনি বলেন চেষ্টা ও ইচ্ছা থাকলে অনেক কিছু জয় করা যায় তার বড় প্রমাণ আমি নিজেই। আল্লাহু আমাকে সে সুযোগ করে দিয়েছেন। মর্মান্তিক সেই দিনটিকে স্বরণ রেখে বাংলাদেশ স্কাউটস রোভার অঞ্চলের একটি প্রতিনিধি দল ২০১৮ সালের ২৩ শে অক্টোবর মেহেরপুর জেলার শহীদ রোভারদের স্মতিসৌধে পুস্পমাল্য অর্পন করেন, দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে শরীক হন। রোভার অঞ্চলের পক্ষ থেকে শোকাহত পরিবারের সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং শুভেচ্ছা উপহার এবং প্রাইজবন্ড প্রদান করেন ১৯৯৭ সাল থেকে মেহেরপুর জেলা রোভার প্রতিবছর এই দিনটি পালন করে আসছে। সেই থেকে জেলা রোভারের দাবী ছিল এই দিনটি রোভার অঞ্চল থেকে পালন করার।
দীর্ঘদিনের দাবীর সাথে একমত হয়ে রোভার অঞ্চলের তৎকালীন সম্পাদক প্রফেসর এ কে এম সেলিম এবং রোভার অঞ্চলের যুগ্ম সম্পাদক প্রফেসর ডঃ কে এম এ এম সোহেলের নেতৃত্বে প্রতিবছর রোভার অঞ্চল এই দিনটিকে তাদের কর্মসূচী হিসেবে পালন করে আসছে যা মেহেরপুর জেলা রোভারের জন্য অত্যান্ত গর্বের বিষয়। স্বাধীনতার পুন্যভুমি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সেই মুজিবনগর তথা মেহেরপুরের জন্য এটাও একটি বড় পাওয়া। ৫ জন শহীদ রোভারের জন্য মেহেরপুরের নজরুল শিক্ষা মঞ্জিলে নির্মিত হয়েছে শহীদ রোভার স্মতিসৌধ। তাদের কবরগুলো আছে মেহেরপুর পৌর কবরস্থানে।