আমেরিকা চাইলে যেকোনও দেশের ক্ষমতা উল্টাতে-পাল্টাতে পারে। উন্নয়নশীল দেশের জন্য সেটি নস্যি। যেদেশ রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিবর্তন করতে পারে, সেদেশের বিরুদ্ধে কিছু বলা মানেই নিজের বিপদ। যেন-তেন প্রকারে ক্ষমতায় থাকতে হলে আমেরিকাকে খুশি করে চলা ছাড়া কোনো পথ নেই। কিন্তু এটা জেনেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন যুক্তরাষ্ট্রের সব কথাতেই হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলান নি। চোখে চোখ রেখে জবাব দিয়েছেন। স্যাংশন বা ভিসানীতি কোন কিছুতেই পরোয়া করেন না তিনি।
কেউ অন্যায় করলে মুখ বুজে সহ্য করেন না বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। জনসম্মুখে তা প্রকাশ্যে আনতে কুণ্ঠা বোধ করেন না তিনি। ২০০১ সালের ২০ মার্চ আমেরিকার প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন বিল ক্লিনটন। ক্লিনটনের কাছ থেকে গ্যাস বিক্রির প্রস্তাব পাওয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বলেছিলাম, আমাদের দেশে কত গ্যাস আছে, আমরা এখনো জানি না। আমাদের দেশের সামান্য কয়েক পার্সেন্ট মানুষ এই গ্যাস সুবিধাটা পাচ্ছে। কতটা গ্যাস আছে এটা না জানলে; আমরা কীভাবে আপনাদের ওয়াদা দেবো যে, আমি ক্ষমতায় গেলে গ্যাস বিক্রি করবো।’
২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। পরবর্তীতে আন্দোলনের মুখে তত্ত্ববধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা দিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় দলটি। তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভরাডুবি হয় বিএনপির। দলটি পেয়েছিল মাত্র ৩০টি আসন। আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় হয়। বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের ইতিহাসে ২০০৮ সালের নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বীকৃতি পেয়েছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও যথারীতি নির্বাচনে হয়। সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার বিষয়ে অনড় থাকা বিএনপি ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই অংশ নেয়। বিএনপি পায় মাত্র পাঁচটি আসন৷
আবারও দরজায় কড়া নাড়ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই দেশ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আলোচনার কেন্দ্র বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। তাই ঘুরে ফিরে আসছে বিদেশি হস্তক্ষেপের বিষয়। ২০০১ সালের মতো এবারও কী কোনো দেশকে মুচলেকা দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে যেতে হবে? এই প্রশ্ন আরও জড়ালো হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক মন্তব্যকে ঘিরে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমি ক্ষমতায় থাকি তারা (যুক্তরাষ্ট্র) হয়তো চায় না, আমি বাংলাদেশের জন্য যেসব উন্নতি করেছি, সেটা তারা (যুক্তরাষ্ট্র) হয়তো গ্রহণ করতে পারছে না। এটা আমার অনুভূতি।’ বিবিসিকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। গত ১৫ মে রাতে বিবিসির বাংলা বিভাগ তা প্রচার করে।
গেল ১৫ মে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে উঠে আসে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গ। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের কী কারণে স্যাংশন দিল? যাদের দিয়ে আমরা সন্ত্রাস দূর করলাম, জঙ্গি দূর করলাম, তাদের ওপরে? হোলি আর্টিজানে যারা হামলা করেছিল, তাদের দমন করে মানুষ জীবিত উদ্ধার করতে কিন্তু ২৪ ঘণ্টাও লাগেনি। এরপরেও আরও কোন ঘটনা কেউ ঘটাতে পারেনি। এরপরেও স্যাংশনটা কিসের জন্য?’
ভিসানীতি প্রয়োগ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে বাংলাদেশের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নিষেধাজ্ঞা দিলে দেবে।বাইরের দেশ থেকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হলে বাংলাদেশের জনগণও তাদের স্যাংশন দেবে।’গত ২২ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে বসেই যুক্তরাষ্ট্রের চোখ রাঙানির জবান দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তবে সৌজন্যতা দেখাতেও ভুলেন না মানবতার নেত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের সম্মেলনে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেনের রাষ্ট্রীয় ডিনার পার্টিতে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া জি-২০ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বাইডেনের বাংলাদেশের প্রতি যে আগ্রহ ও মনোযোগ আছে সেটির প্রতিফলন ঘটেছে এতে। বাইডেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার কন্যা সায়েমা ওয়াজেদ পুতুল একসঙ্গে যে সেলফি তুললেন তার একটি অর্থ আছে। দুটো দেশের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতভিন্নতা থাকলেও তারা উভয়ই সহযোগিতার সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ইতিবাচকভাবে ইচ্ছুক তারই বহির্প্রকাশ ঘটেছে।
তবে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র যা বলবে তাই মানতে হবে, এমনটি করেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এজন্য প্রয়োজন সততা আর সাহস। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলার এত সাহস কোথায় পান? এই সাহস আছে তাঁর রক্তে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রক্ত চক্ষু উপক্ষে করে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। যদিও পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের উপকূলে সপ্তম নৌবহর মোতায়েন করতে চেয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি কমান্ডার জেনারেল নিয়াজি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের দিনই সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। কিন্তু বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের দখল থেকে মুক্ত।
বঙ্গবন্ধুর দেখানো সেই পথে হাঁটছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। কিন্তু তাঁর এই পথটি পাড়ি দিতে সহ্য করতে হয়েছে অনেক কষ্ট। ১৯৭৫ সালে ছোট বোন শেখ রেহানা ছাড়া পরিবারের সবাইকে হারিয়েছেন। ‘৮১-এর ১৭ মে দেশে ফেরা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। গঠন করা হয় ‘শেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি’। শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর সামরিক শাসনবিরোধী গণআন্দোলন সংগঠিত করেন। ‘৮৩-এর ফেব্রুয়ারিতে শেখ হাসিনাসহ বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাকে সামরিক গোয়েন্দারা চোখ বেঁধে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। একটানা ১৫ দিন তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ‘৮৪-এর ফেব্রুয়ারি ও নভেম্বরে তাঁকে পুনরায় গৃহবন্দি করা হয়। ‘৮৫-এর মার্চে তাকে তিন মাস গৃহবন্দি রাখা হয়। ‘৮৮-এর ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর গাড়িবহরে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। ‘৯৪-এ পাবনার ঈশ্বরদী রেলস্টেশনের উত্তর প্রান্তে বন্দুকধারীরা তার কামরা লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। ২০০৪-এর ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা করা হয়। শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ১৯ বার হামলা হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই ভয় করেননি তিনি, অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি।
সততা আর জনতার বিশ্বাস যেকোনো নেতাকে সাহসী করে। অন্যায় না করলে অন্যতে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। মানুষের মঙ্গল করলে অবশ্যই দেশবাসী তার প্রতিদান দেবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাই জনগণের উপর ভরসা রাখছেন। তাই তিনি বলেছেন, ‘জনগণ ভোট দিলে আছি, না দিলে নাই। এ নিয়ে আফসোস নাই।’ প্রধানমন্ত্রী যেমন আমাদের ওপর ভরসা রাখছেন, তেমনি তাঁর ওপর আমাদেরই ভরসা আছে। শুভ জন্মদিন মানবতার আলোকবর্তিকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।