আমার প্রথম সমুদ্র যাত্রা

আমার প্রথম সমুদ্র যাত্রা

বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি চট্টগ্রাম থেকে পাসিং আউটের পর আমি ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের একটি জাহাজ বাংলার কাকলিতে ডেক ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করি। এটি ছিল জেনারেল কার্গো জাহাজ। প্রায় সব ধরনের ড্রাই কারগো বা মালামাল এটিতে পরিবহন করা হতো।

জাহাজটির দৈর্ঘ্য ছিল ১৫৫ মিটার প্রস্থ ২২ মিটার, সামার ডেড ওয়েট ১৭২৩৪ টন এবং পোর্ট অফ রেজিস্ট্রি ছিল চট্টগ্রাম। জাহাজটি তৈরি জাপানে এবং সবদিক দিয়েই এটি একটি ভালো জাহাজ ছিল। জাহাজটিতে কার্গো গেয়ার ছিল ক্রেন,ডেরিক এবং জাম্বো ডেরিক কারগো অপারেশন এর জন্য।

জাহাজে আমার প্রথম ভয়েজ ছিল মোংলা থেকে করাচি বন্দর। আমরা মোংলা বন্দর থেকে জুট বা পাট বেল আকারে লোড করি। কারগো লোড করতে প্রায় ১৫ দিনের মতো সময় লেগেছিল। বৃষ্টি হলে কারগো বন্ধ থাকতো এ কারণেই লোডিং এ একটু বেশি সময় লেগেছিল। এছাড়া কারগো জাহাজের ক্রেন দিয়ে দিয়ে লোড করা হতো। আমরা সে সময় রিভার মোরিং এ কারগো লোড করেছিলাম পাকিস্তানের করাচি বন্দরের জন্য।

মোংলা থেকে বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগর হয়ে আমরা করাচি বন্দরে পৌঁছাই। আমাদের করাচি যেতে প্রায় ১২ দিনের মতো সময় লেগেছিল।

আমরা মে মাসে মংলা থেকে করাচির উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। মুনসনের প্রভাবে এই সময়ে বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগর দুটোই উত্তাল থাকে। বঙ্গোপসাগরে পড়তেই জাহাজে রোলিং পিচিং শুরু হয়ে গেল। আমার জন্য এটি ছিল নতুন এক অভিজ্ঞতা। কখনো কখনো আস্তে জাহাজটি দোলে আবার কখনো কখনো বড় ঢেউয়ের ধাক্কায় বেশি দুলতে থাকে। এভাবে আমাদের যাত্রা শুরু হল।

জাহাজে আমরা তিনজন ব্যাচমেট ছিলাম, দুইজন ডেক ক্যাডেট এবং একজন ইঞ্জিন ক্যাডেট। তিনজনই আমরা সবেমাত্র জাহাজে যোগদান করেছি। ক্যাডেটদের রুমে ছিল ডাবল বাঙ্ক বেড বা দোতলা খাট। ডেক ক্যাডেট কেবিনে আমি এবং আমার একজন ব্যাচমেট থাকতাম আর ইঞ্জিন ক্যাডেট রুমে আমার আরেকজন ব্যাচমেট একাই থাকতো।

ক্যাডেট হিসেবে জাহাজে যোগদানের পর থেকেই শুরু হয়ে যায় ট্রেনিং। সব ধরনের কাজেই অংশগ্রহণ করতে হতো। কখনো অফিসারদের সাথে কখনো ক্রুদের সাথে আবার কখনো ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে কাজ করতে হতো। জয়েনিং এর পরে প্রথম ৬ মাস আমাদের প্রতিদিন ১২ ঘন্টার বেশি কাজ করতে হতো। তারপর আস্তে আস্তে কাজ শিখে গেলে কাজের সময় কিছুটা কমে আসে। ক্যাডেটদের প্রধান কাজ হল সবার সাথে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করা। এভাবেই জাহাজের ক্যাডেটরা ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতা অর্জন করে থাকে যা পরবর্তীতে প্রতিটি পদেই কাজে আসে।

এভাবে আমরা রোলিং পিচিং নিয়ে চলতে থাকি এবং আমাদের ক্যাডেটদের সকলেরই কিছুটা সী সিকনেস দেখা দেয়। মাথা ঘুরতে থাকে এবং বমি বমি ভাব হয়,কখনো কখনো আবার বমিও হয়েছে। যদিও এসব কিছুর মাঝেই আমাদের কাজ করতে হয়েছে। যখন আমরা আরব সাগরে পড়ি তখন সমুদ্র আরো বেশি উত্তাল হয়ে যায়। সামুদ্রিক নিম্ন চাপের কারণে জাহাজটি আরো বেশি দুলতে থাকে। কখনো কখনো ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রির মত রোলিং হয়। আমরা যারা নতুন জাহাজে জয়েন করেছি তাদের জন্য দিনগুলো খুব কষ্টের ছিল। এভাবে কয়েকদিন চলার পর সমুদ্র কিছুটা ভালো হয়ে যায়। তখন আমরা কিছুটা স্বস্তি বোধ করি। এভাবে আস্তে আস্তে আমাদের সী সিকনেস কেটে যায়। সকল নাবিকদেরই প্রথমদিকে এরকম সী সিকনেস হয়।
১২ দিন পর যখন করাচি বন্দরে পৌঁছাই তখন খুব শান্তি লেগেছিল। এটিই আমার প্রথম ফরেন পোর্ট। আমাদের জুট বা পাট ডিসচার্জ করতে ৭ দিনের ও বেশি সময় লেগেছিল।

বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের জাহাজ হওয়াতে জাহাজটিতে ফ্যামিলি নিয়ে সেইল করা যেত। আমাদের জাহাজে চিফ অফিসার এবং সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার স্যারের ফ্যামিলি ছিল। জাহাজের পরিবেশটাও ছিল চমৎকার। সবাই বাংলাদেশী হওয়াতে খাওয়া-দাওয়াতে কোন কষ্ট হয়নি। মাঝে মাঝে ভাবিরাও রান্না করে আমাদের খাবার খাইয়েছে। সমুদ্রের অবস্থা ভালো থাকলে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর টেবিল টেনিস খেলা হত মাঝে মাঝে টুর্নামেন্টও হত। এভাবে কাজের মধ্যেও বেশ আনন্দে কেটেছে আমাদের দিনগুলো। জাহাজে সিনিয়রদের থেকে অনেক কিছু শিখেছি। শাসন করলেও তারা আমাদের অনেক কিছুই শিখিয়েছেন।

বন্দরে আমাদের জাহাজটি বেশ কিছুদিন অবস্থান করায় করাচি শহরটি ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছিল। করাচি পাকিস্তানের প্রধান সমুদ্র বন্দর। এটি আরব সাগরের উপকূলে অবস্থিত। রাস্তায় আলোর কারণে এটিকে আলোর শহরও বলা হয়। করাচি পাকিস্তানের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসাবেও পরিচিত। এটি ক্রীড়া জগতের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। করাচির সংস্কৃতি বৈচিত্র্যময় কারণ এখানে মহাজির,সিনজি, পাঞ্জাবি সহ বিভিন্ন সম্প্রদায় একত্রে বসবাস করে। এছাড়াও এখানে প্রায় দুই মিলিয়নের মতো বাঙালি বসবাস করে। দুঃখের বিষয় হল সেখানকার বসবাসরত বাঙালিরা ভোটাধিকার এবং দেশের অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। জানা যায় তাদের জাতীয় পরিচয় পত্র না থাকায় তারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না এবং সরকারি চাকরি পায় না। তাই বাঙালি পরিবারগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মানবেতর জীবনযাপন করছে। বাঙালিরা এখনো সেদেশের নাগরিকত্ব পায়নি।

সমুদ্রের কাছাকাছি থাকায় করাচি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। বিন কাশিম বন্দর এবং জিন্নাহ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এখানেই অবস্থিত। এখানকার দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো কায়েদে আজম মাজার,মহাত্মা প্যালেস, ফ্রিরিহল,ডলমেন শপিং মল, আলাদিন পার্ক, পিএএফ মিউজিয়াম,সীভিউ বিচ ইত্যাদ।

আমার সে সময় কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর মাজার,কয়েকটি শপিং মল এবং সীবিচে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছিল। সেই সাথে বেশ কয়েকটা রেস্টুরেন্টে খাবার খেয়েছি। এখানকার খাবারের মধ্যে লাহরি বিরিয়ানি,আফগান রুটি, কাবাব, তন্দুরি রুটি অন্যতম। এছাড়াও কাটোয়া গোশত,সিরি পায়া, কাবুলি পোলাও, চারসি টিক্কা,দুম্বা কারাহি কয়েকটি জনপ্রিয় খাবার। এর মধ্যে কয়েকটি খাবার খেয়েছিলাম সে সময়। খাবারগুলো খুব টেস্টি বলে মনে হয়েছে। টুকটাক শপিংও করেছিলাম। করাচি থেকে কেনা একটি পাঞ্জাবী আজও আমার কাছে অক্ষত অবস্থায় রয়েছে।

এভাবেই আমি আমার প্রথম ভয়েজে সুন্দর কিছু সময় পার করেছিলাম। এখনো মনের মধ্যে প্রথম সমুদ্রযাত্রার স্মৃতিগুলো গাঁথা রয়েছে।

লেখক: মাস্টার মেরিনার, (এ এফ এন আই), এক্স ক্যাডেট, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি চট্টগ্রাম।