যাত্রাশিল্পী আব্দুর রব এখন বেকার, সম্পূর্ণ বেকার। বয়স্ক ভাতা পেতে সমাজ সেবায় আবেদন করেছিলেন বছর খানেক আগে। এখনও ভাতা পেতে তালিকায় নাম উঠেনি। ভাতা পাবার জন্য অনেকের দারস্থ হচ্ছেন।
আশির দশকের যাত্রামঞ্চের চূড়ামনি, মঞ্চমাতানো ডার্ক-হিরোর এখন আর কোনো কাজ নেই। পেশাদারি ও অ্যামেচার মঞ্চ যিনি এক সময় দাঁপিয়ে বেড়িয়েছেন, সেই তিনি-ই কোনো রঙ্গমঞ্চে পা দেবার শক্তি হারিয়েছেন। রোগশোকে হারিয়েছেন কর্মশক্তি। শহরের হোটেল বাজারের মৌসুমী টেইলার্সেও আর বসেন না। প্রয়াত স্ত্রী আর যাত্রার আলোকোজ্জ্বল রঙ্গমঞ্চ ও দর্শকদের ভালবাসার স্মৃতি তার বড় সম্বল। তার শরীরে বাসা বেঁধেছে বার্ধক্যজনিত রোগ। সেসব রোগের চিকিৎসার আর্থিক প্রয়োজনে তাকে স্বজনদের কাছে হাত পাততে হয়।
প্রতিদিন সকাল হলেই অসুস্থ শরীর নিয়ে লাঠিতে ভর করে শহরের পরিচিত স্বজনদের কাছে ছুটে যান। সেসব স্বজনদের দেয়া সহায়তায় ওষুধ কিনে থানা সড়কে মুখার্জি পাড়ার বাড়িতে ফেরেন। তিন সন্তানের পিতা রব। দুই ছেলে পৃথক। ছোট ছেলে তার সাথে। সেই ছেলে শহরের হোটেল বাজারে রাস্তার পাশে চা স্টলের উপর্জনে চলে চার সদস্যের সংসার চালাতে নুন আনতে পান্তা ফুরায়।
আব্দুর রব শহরের হোটেল বাজারে একটি ফার্মেসীর পাশে বসেছিলেন ওষুধ কেনার সহায়তা পেতে। কেমন আছেন জানতে চাইলে এই অভিনেতার চোখ দিয়ে পানি ঝরতে শুরু করে। এক সময় যাত্রামঞ্চেও চোখে পানি ঝরেছে। সে পানি কৃত্রিম। তিনি বলেন- “অভিনয় জীবনে সংসার, সমাজ, দেশের দুঃসাশনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি। আজ নিজ জীবনের হিসাব মেলাবার চেষ্টা করছি হাত পেতে। জেলা সমাজসেবা অফিসে দুস্থ ভাতার জন্য এক বছর আগে আবেদন করেছিলাম। এখনও কোন সাড়া পা্ইনি।
জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বলেন- দুস্থ যাত্রাশিল্পী হিসেবে বার্ষিক সহায়তা করা হয়।
মেহেরপুরের যাত্রাশিল্পের পরম্পরায় এক অনিবার্য নাম আব্দুর রব। যাত্রাশিল্পকে মেহেরপুরের সর্বস্তরের মানুষের কাছে জনপ্রিয় করতে কৈশোর থেকে কাজ করেছেন তিনি। বিরল এই অভিনেতা বহু পালায় নির্দেশক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। শারীরীক কারণে যাত্রার আসর ছেড়েছেন প্রায় দেড় দশক আগে, তারপরও যাত্রাশিল্পী হিসেবে তার নাম আজও এ জনপদের মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
বিশ শতকের আশির দশক পর্যন্ত আব্দুর রব নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন কখনও অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে, কখনও-বা যাত্রা সংগঠক হিসেবে। তিনি নিজগ্রাম ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার পাটিকাবাড়িতে একটি নাট্যসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। খ্যাতিমান অভিনেতারা সেই দলে অভিনয় করতেন।
আব্দুর রবের জন্ম ১৯৫২ সালে মুর্শিদাবাদ জেলার পাটিকাবাড়ি গ্রামে। তার বাবার নাম আহসান নবী, মাতা ছুরাতন বিবি। ১৯৬৯ সালে তার পরিবার মেহেরপুর শহরের মুখার্জি পাড়ায় স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। জীবিকা হিসেবে বেছে নেন দর্জির কাজ। কৈশোর থেকেই তিনি সংস্কৃতিমনস্ক ও যাত্রামোদী। যাত্রাগানের আলোক-উজ্জ্বল রঙ্গমঞ্চ, সাজঘর, যাত্রাপালার অতিনাটকীয় সংলাপ আর অর্কেস্ট্রাদলের সুরমুর্ছনা তাকে মুগ্ধ, বিহবল ও আলোড়িত করত বেশি। যেখানেই যাত্রার আসর, সেখানেই তিনি বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে হাজির হতেন। একটি পয়সা দাও, কলংকিনি বধূ, এক মুঠো অন্ন চাই, ময়লা কাগজ, নাচমহল, কোহিনূর, অশ্রু দিয়ে লেখা, রক্তে রোয়া ধান, অচল পয়সা, অনুসন্ধান, দেবী সুলতানা প্রভৃতি যাত্রাপালায় অভিনয় করে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন।