নাসির উদ্দীন মিরু ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে মারা গেছেন।
নাসির উদ্দীন মীরুর স্বরণে:
মানবমুক্তির নহবত শুনে যে জীবনের যাত্রা সে জীবনকে আরো বর্ণাঢ্য ও আলোকিত করে তুলেছিলেন নাসির উদ্দীন মীরু শিল্প সংস্কৃতি সাহিত্য জগতে পদচারণার মধ্য দিকে। ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথের জন্ম শত বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে সাংগঠনিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ, স্কুলে দেয়ালিকা প্রকাশ, অমর একুশে স্মরকপত্র ও কবিতাপত্র বের করার মধ্য দিয়ে তার সংস্কৃতি জগতে প্রবেশ। এরপর পাঁচ দশক ধরে শিল্প সাহিত্য সাংবাদিকতা রাজনীতির নানাদিক নিয়ে নানা ধরনের কাজ করে চলেছেন।
নাসির উদ্দীনের জন্ম ১১ নভেম্বর ১৯৪৬ অবিভক্ত নদীয়ার করিমপুর থানার ফাজিলনগর গ্রামে। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে তার পরিবার মেহেরপুর শহরে চলে আসে। তার পিতা নকিব উদ্দীন ছিলেন সচ্ছল কৃষক। নাসির উদ্দীন মেহেরপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। মেহেরপুর কলেজ থেকে আই কম ও বিএ ডিগ্রী অর্জন করেন। বাল্য কৈশোর থেকেই নেতৃত্বের গুণাবলি তার ব্যক্তি চরিত্রে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক্রমশ বিকশিত হতে থাকে তার সাংগঠনিক দক্ষথা ও সৃজন বৈশিষ্ট্য। স্কুল-কলেজে ছাত্রাবস্থায় ‘সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাজে তিনি ছিলেন অগ্রণী। তাঁর পরিমিতিবোধ, দক্ষতা, শিল্পবোধ, চারিত্রিক, দৃঢ়তা তাকে আকর্ষনীয় ও উদাহরণ তুল্য সংগঠকে পরিণত করে। তিনি ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৬৪ সালে আব্দুল আওয়ালকে সভাপতি সিরাজুল ইসলাম কে সম্পাদক করে মেহেরপুর ছাত্র ইউনিয়নের যে কমিটি গঠিত হয় তাতে নাসির উদ্দীন ছিলেন মূল সংগঠন। এ সময় আবু বক্কর, আহমদ আলী, শাখাওয়াত মুন্সীরা, ভাষানী-ন্যাপ সংগঠিত করছেন। আর আওয়ামী লীগের দায়িত্বে আছেন এ্যাড. আবুল হায়াত, সহিউদ্দীন, মফিজুর রহমান প্রমুখ। ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও সক্রিয় থেকেছেন যুগপৎ। ষাটের দশকে তিনি উদার, প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে ‘মধুচক্র’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। সে সময় এ সংগঠনের উদযোগে অনুষ্ঠিত হয় রবীন্দ্র-নজরুল, সুকান্ত জন্ম জয়ন্তী, মধুসূদন উৎসব সহ নানা সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিয়ে তিনি অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন সনদ বা স্বীকৃতি চাননি তিনি। কারণ তার দৃষ্টিতে স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতক দালালরা ছাড়া এদেশের সব মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কাজ করেছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের নৈতিক পীড়িত ও ক্ষুদ করে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালেও তিনি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড থেকে সরে থাকেননি। মেহেরপুরে স্বাধীনতা বিরোধীদের তালিকা তিনিই প্রথম প্রনয়ন করেন। নাসির উদ্দীন একজন আপদমস্তক রাজনীতি কর্মী। তবে রাজনীতিকে কখনও ক্ষমতা দখলের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেননি। ১৯৭৮ সালে অধ্যাপক আনসার উল হক, আলী ওবায়দুর রহমান মেরাজ কে নিয়ে তিনি মেহেরপুর থেকে সাপ্তাহিক প্রবাহ বের করতেন। ’৮০ দশকে পত্রিকার ওপর সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন নিষেধজ্ঞা আরোপ করলে, এটি বন্ধ হয়ে যায়।
নাসির উদ্দীনের ব্যক্তি জীবন, সংস্কৃতি ভাবনা ও সাংগঠনিক কর্মকান্ড এক সূত্রে গাঁথা। জীবনের প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে তার বসবাস গ্রন্থপাঠ, বিশ্লেষণ ও সে আলোকে কিছু করার ভাবনা থেকে। এ সুযোগ পেয়েছিলেন সরকারি গণ গ্রন্থাগারে গ্রন্থাগারিক হিসেবে কাজ করার সুবাদে এবং বিভিন্ন সংগঠনের দায়িত্ব পালনের সূত্রে। তিনি কুষ্টিয়া বসবাসের সময় রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিষদের হয়ে কাজ করেছেন, আবার বিজ্ঞান চেতনা পরিষদেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। আলোর পথের যাত্রী হিসেবে তিনি সারা জীবন আলো দিয়ে আলো জ্বালার কাজটি করে যাচ্ছেন। প্রতিপক্ষকে বুলেটবিদ্ধ না করে যুক্তি ও ভালবাসা দিয়ে জয় করার কথা বলছেন তিনি সব সময়। নিজেই মার্কসীয় ধারার রাজনীতি করেছেন, তথাপি ভিন্ন মতাবলম্বীদের সখ্য সম্পর্ক রেখেছেন।
রাজনৈতিক কারণে কখনও কারো সাথে দ্বন্দ্ব-হানাহানিতে লিপ্ত হননি। তিনি জানতে হিংসা হানাহানিতে কোন সমস্যার সমাধান নেই। তাই মানুষের অন্তনির্হিত শুভ প্রত্যয়ের উজ্জীবনের ওপর জোর দিতেন আর তার সব কর্ম প্রয়াস ও উদযোগ চালিত হয়েছে মানুষকে ঘিরে এবং শুভবোধ উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে।
নাসির উদ্দীন লেখালেখি জগতের সাথে থাকলেও নিজে তেমন লেখেননি। পড়াশুনার প্রতিই তার বরাবর আগ্রহ। প্রথম যৌবন মাক্স লেনিন মাও জে দং নিয়ে পড়াশুনা করেছেন এবং মার্কসীর দর্শনের আলোকে গড়ে ওঠা সমাজকে শ্রেষ্ঠ সমাজ বলে গন্য করেছেন। তবে সমসাময়িক অন্যান্য তাত্ত্বিকের মতো গোঁড়ামিরা সংকীর্ণতায় আচ্ছন্ন ছিলেন না। অখন্ড মানবিক দর্শনের পক্ষে সব সময় দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। নাসির উদ্দীন পাশ্চাত্য সাহিত্য-দর্শন নিয়ে যেমন পড়েছেন। তেমনি আফ্রো-ঐশীয় লাতিন আমেরিকার সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। সমকালীন সাহিত্যিকদের লেখা পড়েছেন গভীর মনোযোগে। মেহেরপুরের লোক সাহিত্য, ইতিহাস জীবনে নানা কাজের সাথে নিজেকে যুক্ত করেছেন। তবে সুস্থ, সাংস্কৃতিবান, আলোকিত মানুষ গড়ার জন্য করি কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, অভিনেতা, চিত্র শিল্পী, সঙ্গীত শিল্পীদের নিয়ে কাজ করেছেন বেশি।
অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী এই শ্রমী পুরুষের সাড়ে ছয় দশকের জীবনে যেমন সাফল্যের গৌরব আছে, তেমনি আছে ব্যর্থতার গ্লানি। সাফল্যের গৌরব প্রাণিত করলেও ব্যর্থতা তাকে পীড়িত বা বিপন্ন করে না। বরং ‘বিপন্ন বিস্ময়’ নিয়ে এগিয়ে যান আঁধার ছেঁড়া সংকল্পে নিঃসংশয়ে নির্ভয়ে।
——-জেলা শিল্পকলা একাডেমির একটি প্রকাশনা থেকে।