কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে দেশজ ও আমদানি বিকল্প রপ্তানীমুখী পণ্য উৎপাদনে সহায়তাকরণের লক্ষ্যে প্রণোদনা দিয়েছে সরকার। সেই “ প্রণোদনা প্যাকেজ ঋণ কর্মসূচি” প্রকল্পে এলাকা বৈষম্য, আত্মীয়করণ ও নীতিমালা না মানার অভিযোগ উঠেছে মেহেরপুর বিসিক ঋণ কমিটির বিরুদ্ধে। তবে বিসিক কর্মকর্তাদের দাবি ঋণ বিতরণে কোন স্বজনপ্রীতি বা বৈষম্য করা হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোভিড-১৯ এ ক্ষতিগ্রস্থ কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের সহায়তার লক্ষ্যে মেহেরপুর বিসিকের অনুকুলে এক কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ঋণ কর্মসূচি কমিটিতে মেহেরপুর বিসিকের উপ-ব্যবস্থাপক আশানুজ্জাান,সভাপতি শিল্প নগরী কর্মকর্তা শেখ সাইফ আহমেদ সদস্য সচিব এবং হিসবারক্ষক সাদ্দাম হোসেন ছিলেন সদস্য।
বরাদ্দের টাকা প্রথমে ফেরৎ পাঠানোর চিন্তা করলেও স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতাদের আহবানে সে ঋণ বিতরণ করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে তড়িঘড়ি করে ঋণ বিতরণে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। এ ক্ষেত্রে ঋণ কর্মসূচির বিষয়টি প্রচারণার ঘাটতির কারণে অনেক উদ্যোক্তা আবেদনও করতে পারেননি। যারা আবেদন করেছেন তাদের অনেককে ঋণ দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। বিসিক শিল্প নগরীর ব্যবস্থাপক ও প্রণোদনা ঋণ কমিটির সভাপতি আশানুজ্জামান মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার মটুমড়া গ্রামের বাসিন্দা। যে কারণে নিজ গ্রামসহ তাঁর উপজেলাতেই তিন চতুথাংশ ঋণ বিতরণ করেছেন এমন অভিযোগ উঠেছে।
প্রণোদনা প্যাকেজ ঋণ কর্মসূচির তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মেহেরপুরের তিন উপজেলা ও বিসিক শিল্প নগরী মিলে ৪৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা প্রণোদনা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। যার মধ্যে গাংনী উপজেলার ৩০টি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে ৭৫ লাখ ১০ হাজার টাকা, সদর উপজেলার ১১টি প্রতিষ্ঠানকে ১৪ লাখ ৯৯ হাজার টাকা, মুজিবনগর উপজেলার মাত্র ২টি প্রতিষ্ঠানকে ৫লাখ এবং মেহেরপুর বিসিক শিল্পনগরীর ২টিপ্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে ৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মোটা অংকের ঋণ গুলো দেওয়া হয়েছে ব্যবস্থাপকের বন্ধু, আত্মীয় ও এলাকাতেই। বিশেষ করে ৩২ জনের অধিকাংশ আবার তার আশেপাশোর গ্রামের উদ্যোক্তা।
তালিকা থেকে আরো দেখা গেছে, ৪৫টি প্রতিষ্ঠানের ৩২টিকেও দেখানো হয়েছে খাদ্যজাত প্রতিষ্ঠান হিসেবে, ৯টিকে বস্ত্র শিল্প, ২টি উৎপাদন শিল্প, একটি আসবাব শিল্প এবং একটি প্রকৌশল শিল্প। অথচ প্রণোদনা প্যাকেজ ঋণ কর্মসূচি প্রকল্পে উৎপাদন শিল্পকে বেশি গুরত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যদিও ঋণ কমিটির সদস্য সচিব শেখ সাইফ আহমেদ দাবি করেছেন, মেহেরপুর কৃষি ভিত্তিক জেলা হিসেবে ডেইর ফার্ম, পোল্ট্রি ফার্ম ও মৎস্য ফার্মকেও উৎপাদনমুখী শিল্প হিসেবে ধরা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, এই তিনটি খাতের প্রতিষ্ঠানও মেহেরপুর সদর ও মুজিবনগরে অনেক থাকা সত্তেও তারা কেনো পেলোনা।
বিসিক শিল্প নগরীর মেসার্স মোমিনুল ম্যানুফ্যাকচারিং লি. এর স্বত্ত্বাধিকার আজিজুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, আমাদানি বিকল্প শিল্প প্রতিষ্টান গড়ে তুলেছি। প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে আশাবাদি ছিলাম। সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা ঋণ পাওয়ার আশায় আবেদনও করেছিলাম। কিন্তু আমাকে ঋণ দেওয়া হয়নি। এমনকি কিছু বলাও হয়নি।
বিসিক শিল্পনগরীর আল মদিনা স্টিল কিং এর মালিক মনিরুজ্জামান বলেন, ভরসা না পেয়ে প্রণোদনা ঋণের আবেদন করিনি। তবে ঋণ বিতরণের পর মর্মাহত হয়েছি। বিসিকে মেসার্স মোমিনুল ম্যানুফ্যাকচারিং নামে আমদানী বিকল্প একটি ম্যানুফ্যাকচারিং রয়েছে। তাকেও এ ঋণ দেওয়া হয়নি। এ ধরণের খাতকে এগিয়ে নিতে তাকে প্রণোদনা সর্বোচ্চ ঋণ দেওয়ার দরকার ছিল।
মেহেরপুর শহরের বড়বাজারের মৌ বুটিক শপ এন্ড টেইলার্সের মালিক মাহিমা মাহাজাবিন তিথি বলেন, আমার এখানে কিছু পণ্য উৎপাদন করি। যে কারণে ৪ লাখ টাকার আবেদন করেছিলাম। কিন্তু এক লাখ দেওয়া হয়েছে তাকে। তিন মাস পর থেকে কিস্তির জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৩টি কিস্তি দেওয়া হয়েছে। তবে আমাকে বেশি ঋণ দিলে আমার ব্যবসা করতে সুবিধা হতো।
মেহেরপুর কোর্ট সড়কের স্কয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপের স্বত্ত্বাধিকার আবুল কালাম আজাদ বিশ্বাস বলেন, আমরার অনেক পুরাতন প্রতিষ্ঠান। কৃষিসহ শিল্প প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রাংশ উৎপাদন করি। বিসিকে প্রণোদনার ঋণের আবেদন করেছি। কিন্তু আমাকে এ বরাদ্দে ঋণ দেওয়া হয়নি। আমি অফিসে যোগাযোগ করলে তারা খুব বেশি গুরত্ব দেয়না। পরে ঋণ শেষ আসলে পাবেন বলে ছয় মাস ধরে ঘোরাচ্ছেন।
বাংলাদেশ জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতির (নাসিব) মেহেরপুর জেলা শাখার সভাপতি নাইমুর রহমান বলেন, ঋণ বিতরণে এলাকাকরণ করণ হয়েছে। এখানে হালকা ও প্রকৃত শিল্প উদ্যোক্তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। ফলে সরকারের যে লক্ষ্যে ছিল তা বাস্তবায়নে মেহেরপুর বিসিক ব্যর্থ হয়েছে। একই সঙ্গে প্রকৃত উদ্যোক্তারাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন।
বিসিক শিল্প নগরীর আদ্র প্রিন্টার্সের মালিক ও বিসিক শিল্প প্লট মালিক সমিতির সহ-সভাপতি আমিনুল ইসলাম খোকন বলেন, বরাদ্দটি বিতরণ না করে ফেরৎ দেওয়ার চিন্তা করছিলেন কর্মকর্তারা। তখন আমরা ফেরৎ না দিয়ে ঋণ বিতরণের বিষয়ে তাদের আহবান জানায়। যা হোক পরে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। তবে ঋণ বিতরণের যে বৈষম্য ও স্বজনপ্রীতি দেখা গেল তা নি নিয়ে আমি বিস্মিত। এই বৈষম্য ও স্বজনপ্রীতি করা সমিচিন হয়নি।
মেহেরপুর শিল্প ও বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরিফুল এনাম বকুল বলেন, বিসিক শিল্প নগরীর ঋণ কমিটির এ বৈষম্য করা উচিত হয়নি। ঋণ বিতরণে তাদের আরো সতর্ক থাকা উচিৎ ছিলো।
মেহেরপুর বিসিক শিল্প নগরী কর্মকর্তা ও প্রণোদনা ঋণ কমিটির সদস্য সচিব শেখ সাইফ আহমেদ বলেন, খুব কম সময়ের মধ্যে ঋণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়েছে। সেক্ষেত্রে মুজিবনগর ও সদর থেকে আবেদনও কম পড়েছে। গাংনী থেকে আবেদন বেশি হওয়ায় সেখানে বেশি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কর্মকর্তার বাড়ি গাংনী হলেও আমরা কমিটির সকলে মিলেই এ ঋণ বিতরণ করেছি। এখানে কোন বৈষম্য করা হয়নি।
তবে মেহেরপুর বিসিক শিল্পনগরীর ব্যবস্থাপক আশানুজ্জামান বলেন, ঋণ বিতরণে বৈষম্য বা স্বজনপ্রীতি কোনটিই করা হয়নি। যাচাই বাছাই করে যাকে যেমন দেওয়া প্রয়োজন মনে হয়েছে তাকে তেমন পরিমানের ঋণ দেওয়া হয়েছে। ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।