প্রিয় আমেরিকান ত্রয়ী। আমি সেরকম কেউ নই। খুব সাধারণ মানুষ। ১৬০ তো বটেই আপনারা যদি ১০৬০ জন বিশিষ্ট মানুষের তালিকা করেন তার মধ্যে আমার নাম পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই। সম্প্রতি আপনাদের নোবেল জয়ী বন্ধু ড. ইউনূসের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের সরকার প্রধানকে যে বিব্রতকর খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন তার প্রতিবাদ করেছেন আমার দেশের ১৭১ জন নাগরিক। এর মধ্যেও আমার নাম নেই। তবু আমি বিব্রত। আমি কেন, যেকোন মিথ্যাচারে বহু মানুষ বিব্রত হয়। আমি আসলে তাদের প্রতিনিধি।
কোন ভুমিকায় না গিয়ে একটি বিষয় আমি সরাসরি বলতে চাই। ইউনূস সাহেবের ব্যাপারে আপনার না জেনে, না তদন্ত করে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। আজ বলে নয়। অনেক দিন ধরেই দিচ্ছেন। যেটা আপনাদের সারা জীবনের ক্যারিয়ারের সঙ্গে সাংঘার্ষিক। ভুল বুঝবেন না দয়া করে। আমি সরকারের পক্ষ নিচ্ছি না। আমি প্রথমত বিব্রত আপনাদের জন্যে। কারণ আপনাদের জানি। আপনারা যার যার ক্ষেত্রে এভারেস্ট সমান উঁচু। নিজের দেশতো বটেই সারা পৃথিবীর মানুষের কথা আপনারা ভাবছেন। কাজ করছেন। শুধু বাংলাদেশের সামনে এসে কেন বিতর্কিত হবেন?
তবু যদি বলেন এটা আপনাদের ব্যক্তিগত আচরণ। তাহলে হয়তো এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু মূল সমস্যাটা বর্তমান সময়ের। সামনে আমাদের জাতীয় নির্বাচন। এই সময়ে আপনাদের চিঠির মধ্যে লাভের আশা খুঁজছে একটি গোষ্ঠী। আর আপনাদের বন্ধু এক ঢিলে দুই পাখি মারছেন। নিজের অন্যায়ের পক্ষে জনমত গঠনও হচ্ছে, সরকারের ওপর ঝোপ বুঝে কোপ মারাও হচ্ছে। আর আপনারা এর ক্রীড়ানক হচ্ছেন। তার পরেও যদি এটাই আপনাদের ইচ্ছে হয় আপনারা আপনাদের বন্ধুর পক্ষে বলুন। কিন্তু তদন্ত করে বলুন। আমি নিশ্চিত আপনাদের বন্ধু সব কথা বলেননি। আমি আপনাদের জন্যে সেরকম কিছু না বলা কথা এই চিঠিতে হাজির করছি।
আমাদের একটি জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ছিলো, নাম ২০০০। ওই পত্রিকায় ২০০৯ সালের মে মাসের একটি সংখ্যায় প্রকাশ হয়েছিল ‘সুফিয়ার কবর চাঁদার টাকায় / ইউনূসের হাতে নোবেল’খবরের বিষয়বস্তু, আজকের আলোচিত ইউনূস সাহেব ১৯৭৪ সালে তার ক্ষুদ্রঋণের কাজ শুরু করেছিলেন নিজের গ্রাম থেকে। প্রথম ঋণটি তিনি দিয়েছিলেন এই খবরের সুফিয়া বেগমকে। তিনি গ্রামের মানুষকে জানিয়েছিলেন ইউনূসের গ্রামীণব্যাংকের কথা। খুব অল্প দিনেই দারিদ্র্য পিড়ীত ওই গ্রামে নগদ টাকার মহোৎসব লেগেছিল। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সুফিয়াসহ বহু ঋণ গ্রহিতা গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন।
১৯৯৮ সালে এই সুফিয়া মারা যান প্রায় বিনা চিকিৎসায়। গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে তার দাফনের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর এই ক্ষুদ্র ঋণ, দেশের বেশিরভাগ এলাকায় টেকসই হয়নি। যেসব সংগঠন দরিদ্র মানুষকে টাকা দিয়ে মনিটরিং করেছিলো, তাদের ক্ষেত্রে কিছু কাজ হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ এলাকায় মানুষ হয়েছে ঋণ নির্ভর। এতে ক্ষুদ্র ঋণের বাজার বড় হয়েছে। কিন্তু মানুষের ভাগ্য ফেরেনি। ঋণের চাপে কত মানুষ আত্মহত্যা করেছে তা রীতিমত গবেষণার বিষয় । আপনারা চাইলে কাজটি করে দেখতে পারেন। গোপনে আপনাদের দূত পাঠাতে পারেন ইউনূস সাহেবের মডেল গ্রাম জোবরায়। আজও সেখানে ক্ষুদ্র ঋণের হাহাকার কাটেনি।
আসি যে মামলার সূত্র ধরে আপনারা ইউনুস সাহেবের জন্যে উদ্বিগ্ন, সেটা নিয়ে । পত্রপত্রিকার তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালে গ্রামীণ টেলিকম নামে একটা কোম্পানির ১৭৬ জন কর্মকর্তা “শ্রমিক কর্মচারী কল্যাণ তহবিল” এর প্রাপ্য হিস্যা চেয়ে ১১০টি মামলা করেন। ইউনূস আইনজীবী নিয়োগ করে আদালতের বাইরে এসব অভিযোগ নিষ্পত্তি করেন। সেই নিষ্পত্তিতে তিনি কর্মচারীদের ৪৩৭ কোটি টাকা শোধ করেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ১০৬ টি মামলা প্রত্যাহার করেন। কিন্তু চাকরির শর্ত অনুযায়ী, কোম্পানি মুনাফার ৫ শতাংশ পাওয়ার দাবিতে শ্রম আদালত এবং হাইকোর্টে আবারও মামলা করেন তারা।
কিন্তু এই মামলা নিষ্পত্তির জন্যে ইউনূস আইনজীবীদের নিয়মের বাইরে প্রচুর টাকা দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে বের হয়ে আসে, গ্রামীণ টেলিকমের আইনজীবী ইউসুফ আলী ও জাফরুল হাসান শরীফের তিনটি ব্যাংক হিসাব ও ইউসুফ আলীর ‘ল’ ফার্ম এটর্নিসের নামে ১৬ কোটি টাকা দেয়া হয়। দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তারা গণমাধ্যকে জানান, ‘শ্রমিক কর্মচারী কল্যাণ তহবিল’ কর্মীদের পাওনা সংক্রান্ত অভিযোগ ধামাচাপা দিতে ড. ইউনূস বড় অংক দিয়ে আইনজীবী ভাড়া করেন। কথা ছিল এরা মামলাকারীদের সাথে আদালতের বাইরে পুরো বিষয়টি নিষ্পত্তি করবেন।
শুধু তাই নয় ‘শ্রমিক কর্মচারী কল্যাণ তহবিল’এর হাজার হাজার কোটি টাকা চুরির অভিযোগ ধামাচাপা দিতে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করেন ইউনূস। দুদকের অনুসন্ধানে এসব অভিযোগেরও সত্যতা মেলে। ২০২২ সালে তাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে দেয়া হয়। কর ফাঁকি মামলায় দোষী হন ইউনূস। দোষী সাব্যস্ত হবার পর দিনই উনি ১২ কোটি টাকা কর দেন। কর দিয়েই তিনি প্রমাণ করেন তিনি দোষী ছিলেন।
সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য উঠে আসে তার ট্রাস্ট গঠনের আড়ালে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানে। দেখা যায় নিজের পরিবারের ব্যয়ের টাকাও এ ট্রাস্ট থেকেই নিতেন ইউনূস। এছাড়াও নিতেন উৎসব আপ্যায়ন খরচ এবং টেলিফোন বিল। কিন্তু আইন বলে, কোন কিছু ট্রাস্ট করলে সেখান থেকে খরচ নিতে পারবেন না দাতা। কিন্তু ট্রাস্ট না করে ওই একই কাজ যদি তিনি ব্যবসা হিসাবে করেন, তাহলে পারেন। কিন্তু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কর আর ট্রাস্টের কর এক নয়। কেউ সমাজসেবা করলে, তার কাছ থেকে কম কর নিয়ে উৎসাহ দিতে পারে সরকার।
মোট তিনটি ট্রাস্ট গঠন করেন ইউনূস। একটি ট্রাস্টে এমন বিধান রাখেন, যেখান থেকে তিনি নিজে এবং তার পরিবারের সদস্যরা জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন। অথচ ট্রাস্ট গঠনের আইনে এরধনের কোন নিয়ম নেই। এছাড়াও ইউনূসের নামে শেল কোম্পানি গঠন করে এক কোম্পানির লাভ আরেক কোম্পানিতে দান করে কর ফাঁকি দেয়ার নজির পায় দুদক। শুধু গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের জমা ৫% লভ্যাংশের হিসাবে ৩৬০০ কোটি টাকা ইউনূস অন্য কোম্পানিতে দান হিসাবে সরিয়ে দেন।
এই প্রতিটি ঘটনায় বাংলাদেশের একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করেছে। আপনারা আজীবন সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষায় কথা বলেছেন । তাই নিশ্চয়ই আপনাদের বোঝানোর দরকার নেই যে, বাংলাদেশের সাংবিধানিক কোন কাজ নিয়ে কথা বলতে হলে নিশ্চয়ই তথ্য প্রমাণ নিয়ে কথা বলতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে আপনারা কোন দায়িত্বশীলতা দেখাচ্ছেন না। আমরা জানি বেলারুশে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এলেস বিয়ালিয়াটস্কির দশ বছরের জেল হয়েছে, আপনাদের কোন আওয়াজ পাওয়া যায়নি। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা কর ফাঁকির মামলায় আদালতে ঘুরছেন। আপনাদের সেখানেও দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের সামনে নির্বাচন। এই সময় সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ নিয়েও আপনাদের উদ্বেগের শেষ নেই। নির্বাচনের আগে একটি দায়িত্বশীল সরকার আপনাদের এই দায়িত্বহীন কথার বলি হতে পারে, সে বিষয়টি কি আপনারা আমলে নেন না? এতে কী নির্বাচনী পরিবেশ সুষ্ঠু থাকছে? আমাদের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা নিয়ে দুর্নাম নেই। অথচ আপনাদের চিঠিতে এরকম একটি বিচার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে বলছেন। কাজটি কী ঠিক করছেন?
আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ জানে না যে আপনার দেশে ডোনেশন বলে একটা কথা বলানোর বৈধ প্রথা আছে। রাজনীতিবিদ এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের চ্যারিটি সংগঠন থাকে। সেখানে সেবামূলক কাজের খরচ দিলে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে বিবৃতি পাওয়া সম্ভব। ক্রেস্ট কিম্বা সাটিফিকেটও পাওয়া সম্ভব। ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে দাওয়াতেও তারা আসতে পারেন। কিন্তু সেখানে কোন কিছুই ফ্রি করার প্রথা নেই। আনারা সেই প্রথার বাইরে শুধুই বন্ধুত্ব করছেন এরকম নিশ্চয়ই নয়? করুন, শুধু অনুরোধ জেনে বুঝে করুন।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।