দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শহরের চেয়ে গ্রামেই বেশি। প্রাণঘাতী ভাইরাসটি গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নীরবে ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানে মানুষ স্বাস্থবিধি সেভাবে মানছে না।
জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শও উপেক্ষা করছে। ফলে গ্রামে সংক্রমণ বাড়ছে। গত এক সপ্তাহের স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, শনাক্তের হার গড়ে ২২-২৫ শতাংশ। অর্থাৎ শনাক্তের হার নিুগামী নয়।
এ পরিস্থিতিতে আসন্ন ঈদে মানুষ আগের মতো দল বেঁধে ঢাকা ছাড়লে, স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে কোরবানির পশু কিনতে হাটে গেলে সংক্রমণ আরও বাড়বে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগের তুলনায় পরীক্ষার সংখ্যা কমলেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নতুন রোগী শনাক্তের সংখ্যা আবার বাড়ছে। নমুনা পরীক্ষা কিছুটা বাড়তে থাকায় গত কয়েক দিন নতুন শনাক্তের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী।
পাশাপাশি নমুনা পরীক্ষার তুলনায় পজিটিভ বা আক্রান্তের হারও বেড়েছে। টানা ১৩ দিন পর বুধবার এক দিনে সাড়ে তিন হাজারের বেশি নতুন রোগী শনাক্তের কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৩ হাজার ৫৩৩ জনের দেহে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এর আগে সর্বশেষ ২ জুলাই এক দিনে সাড়ে তিন হাজারের বেশি নতুন রোগী শনাক্তের কথা জানানো হয়েছিল। কোভিড-১৯ শনাক্তের পরীক্ষায় ফি নির্ধারণ এবং উপসর্গ দেখে নমুনা নেয়ার কারণে চলতি মাসের শুরু থেকে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কমতে থাকে।
৩ জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত প্রতিদিন ১৫-১৮ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছিল। এখন সেটা সাড়ে ১৪ হাজারের নিচে নেমেছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বলা হয়, নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১২ হাজার ৮৮৯টি। শনাক্ত হয়েছে ২৭৩৩ জন।
পরীক্ষা কমায় জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে নতুন রোগী শনাক্তের সংখ্যাও কমতে শুরু করে। ফলে সংক্রমণের লেখচিত্র বা গ্রাফ দেখে মনে হবে দেশে সংক্রমণ কমছে। কিন্তু সংক্রমণ শনাক্তের হার কমেনি; বরং বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আপাতদৃষ্টিতে দেশে করোনা পরিস্থিতি স্থিতিশীল মনে হলেও এটি ক্রমশ বাড়ছে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে-গ্রামের দিকে এটি বাড়ছে।
আমেরিকায় বেড়েছিল সুনামির মতো, সে তুলনায় আমাদের দেশে বৃদ্ধির গতি ধীর। কোভিডের কার্ভটা বাড়তির দিকে, যদিও সেটি এখনও শার্প হয়নি। তিনি বলেন, শনাক্তের হার গড়ে ২২-২৫ শতাংশ। অর্থাৎ যারা পরীক্ষা করছেন প্রতি চারজনে একজনে সংক্রমিত হচ্ছেন।
সংক্রমণের মাত্রা আরও বাড়বে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি নির্ভর করছে কোরবানির ঈদে আমাদের আচরণের ওপর। যদি ঈদুল ফিতরের মতো ঢাকার মানুষ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, হাটে বা পথেঘাটে স্বাস্থ্যবিধি না মানে, তাহলে সংক্রমণ আরও বাড়বে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিনি সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পরামর্শ দেন। রোগী শনাক্তের পাশাপাশি তাদের আলাদা করা এবং ওইসব রোগীর কন্টাক্ট ট্রেসিং করে তাদের পরীক্ষা ও আলাদা করতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল খায়ের মোহাম্মদ শামছুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, সরকারি হিসাবেই করোনা সংক্রমণের গতি বৃদ্ধির দিকে।
বর্তমান সংক্রমণের রিপ্রোডাকশন নম্বর (আরনট) জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের আরনট এখনও নির্ধারণ হয়নি।
ইতঃপূর্বে বলা হয়েছিল সংক্রমণের হার ১ দশমিক ০৫। তবে সেই হিসাবটি সামগ্রিকভাবে করা হয়নি। ফলে সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। একজন সাবেক মহাপরিচালক এই ধারণা দিলেও অনেক বিশেষজ্ঞ সেটি প্রত্যাখ্যান করেন।
নমুনা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা জানিয়েছেন, আগে একেক জনকে ৬০-৮০টি নমুনা সংগ্রহ করতে হতো। এখন ২৫-৩০টি নমুনা সংগ্রহ করছেন।
বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনলাইনে নিবন্ধনের মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষার কার্যক্রম চালু আছে। তবে আগামী সপ্তাহ থেকে এই পদ্ধতি সারা দেশেই চালু করতে যাচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
তারা জানিয়েছে, দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা বাড়াতে ল্যাবের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে; কিন্তু ল্যাব বাড়লেও পরীক্ষার সংখ্যা কমছে। দেশে এখন ৭৯টি ল্যাবের মধ্যে নমুনার অভাবে প্রতিদিনই বন্ধ থাকছে কোনো-না-কোনো ল্যাব।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, দেশে করোনা সংক্রমণের পর সর্বোচ্চ নমুনা পরীক্ষা করা হয় ৩০ জুন। ওইদিন ১৮ হাজার ৮৬৩টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষা করা হয় ১৮ হাজার ৪২৬টি।
নমুনা সংগ্রহের অনুপাতে ওইদিন শনাক্তের হার ছিল প্রায় ২০ শতাংশ (১৯ দশমিক ৯৮)। জুলাই মাসে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার সংখ্যা কমতে শুরু করে। কিন্তু বাড়তে থাকে সংক্রমণের হার।
পহেলা জুলাই ১৭ হাজার ৮৭৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। শনাক্তের হার ছিল ২১ দশমিক ১২ শতাংশ। ২ জুলাই ১৮ হাজার ৩৬২টি নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ছিল ১৯ দশমিক ১০ শতাংশ।
৩ জুলাই এই সংখ্যা ও হার যথাক্রমে ১৪ হাজার ৬৫০ ও ২১ দশমিক ২৬ শতাংশ, ৪ জুলাই ১৪ হাজার ৭২৭ ও ২২ দশমিক ৩৩ শতাংশ, ৫ জুলাই ১৩ হাজার ৯৮৮ ও ১৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ, ৬ জুলাই ১৪ হাজার ২৪৫ ও ২২ দশমিক ৪৭ শতাংশ, ৭ জুলাই ১৩ হাজার ১৭৩ ও ২২ দশমিক ৯৮ শতাংশ, ৮ জুলাই ১৫ হাজার ৬৭২ ও ২২ দশমিক ২৬ শতাংশ, ৯ জুলাই ১৫ হাজার ৬৩২ ও ২২ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ১০ জুলাই ১৩ হাজার ৪৮৮ ও ২২ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ১১ জুলাই নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কমে নেমে আসে ১১ হাজারের ঘরে।
ওইদিন ১১ হাজার ১৯৩টি নমুনা পরীক্ষায় রোগী শনাক্ত হয় ২৪ শতাংশ। ১২ জুলাই এই হার যথাক্রমে ১১ হাজার ৫৯ ও ২৪ দশমিক ১১ শতাংশ। ১৩ জুলাই নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার সংখ্যা আগের দুই দিনের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। ওইদিন পরীক্ষা করা হয় ১২ হাজার ৪২৩টি নমুনা।
শনাক্তের হার ছিল ২৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ। বুধবার ১৪ জুন ১৩ হাজার ৪৫৩টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। রোগী শনাক্তের হার ২৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। আর বৃহস্পতিবার শনাক্ত হয়েছেন আরও ২ হাজার ৭৩৩ জন। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ১ লাখ ৯৬ হাজার ৩২৩ জনে।
সোমবার করোনার নিয়মিত বুলেটিনে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার সংখ্যা আগের তুলনায় কমেছে বলে স্বীকার করেন অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা।
তিনি বলেন, নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার সংখ্যা আগের তুলনায় কিছুটা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে অনেকগুলো ব্যাখ্যা দেয়া যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী, একজনের দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করার দরকার হচ্ছে না। সুস্থতা ঘোষণার জন্যও দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করার দরকার হচ্ছে না।
এ জন্য পরীক্ষার সংখ্যা কিছুটা কমেছে। তাছাড়া মন্ত্রণালয় পরীক্ষা করার জন্য একটি ফি নির্ধারণ করেছে। এই কারণেও পরীক্ষা কিছুটা কমতে পারে। যেসব বুথের মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করা হয়, সেখানে আগে ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সময় নির্দিষ্ট করা ছিল।
কিন্তু ৩টার পরও অনেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতেন নমুনা দেয়ার জন্য। এখন দুপুর ১টার পরেই বুথগুলো শূন্য হয়ে যায়। নমুনা পরীক্ষা করার জন্য কেউ আসেন না। তাছাড়া মানুষের মধ্যে আতঙ্ক অনেকটাই কমে গেছে। মানুষ অনেকটা স্বস্তিতে আছে বলা হয়। তাই পরীক্ষা করার বিষয়ে তাদের আগ্রহ কমে গেছে।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, পরীক্ষার হার নিয়ে এখনও নিশ্চিত করে বলার সময় হয়নি। মানুষের সচেতনতা বাড়ায় পরীক্ষার হার কিছুটা কমেছে।
সরকারিভাবে পরীক্ষা কমানো হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারিভাবে পরীক্ষা কমানো হয়নি। তাছাড়া কিটের কোনো ঘাটতি নেই। বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে ৩ লাখের ওপরে কিট রয়েছে।
সূত্র-যুগান্তর