করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে দেশের অর্থনীতিতে সম্ভাব্য মহাদুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের কাছে ৮৭ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের দাবি জানিয়েছে বিএনপি।
স্বল্পমেয়াদী খাতে ৬১ হাজার কোটি টাকা, মধ্য মেয়াদী খাতে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং অতিরিক্ত আরও ৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছে দলটি।
শনিবার গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের পক্ষ থেকে ২৭ দফা প্যাকেজ প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
স্বল্প-মেয়াদী পদক্ষেপ:
‘দিন এনে দিন খায়’ এই ক্যাটাগরির সব শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, ভ্যানচালক, হকার, ভাসমান শ্রমিক, ছিন্নমূল, ভিক্ষুক, ভবঘুরে, সিএনজি ড্রাইভার, ভাড়াভিত্তিক গাড়ি চালক (উবার, পাঠাও ইত্যাদি), পরিবহন শ্রমিক, বস্তিবাসী ইত্যাদি মহামারীর কারণে ঘোষিত লকডাউনে কর্মহীন হয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনতিবিলম্বে এদের মুখে খাবার তুলে দেয়া অপরিহার্য। এদের কারও কারও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকলেও অনেকেরই নাই। স্থানীয় প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে এদের চিহ্নিত করে অনতিবিলম্বে চাল-ডাল-লবণ-তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে। দ্রব্য সামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতি ও জটিলতা এড়াতে পণ্যসামগ্রীর পরিবর্তে নগদ অর্থ দিতে হবে। অমর্ত্য সেন এর ভাষায়- নগদ টাকা দিয়ে দরিদ্ররা দুর্যোগ ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পারে। কোনো প্রকারেই রাজনৈতিক বা দলীয় লোকজনকে এ কাজে সম্পৃক্ত করা যাবে না। প্রাথমিকভাবে এপ্রিল-মে-জুন এই তিন মাসের জন্য জনপ্রতি ১৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করে অনতিবিলম্বে ঘরে ঘরে গিয়ে অর্থ নগদ পরিশোধ করতে হবে।
প্রয়োজনে সামরিক বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে প্রাথমিকভাবে ৩ মাসের জন্য আশ্রয়হীনদের অস্থায়ী আবাসন ও প্রয়োজনে তৈরি খাবার সরবরাহ করে তাদের দু’বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।
এ জন্য ন্যূনপক্ষে ৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে। সব শ্রমিক শ্রেণিকে (গার্মেন্ট, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় শিল্প ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত) সেবার জন্য অর্থ এবং জীবন যাত্রায় সমর্থন দিতে হবে। ৮০ লক্ষের অধিক শ্রমিক বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে কাজ করছে। তাদেরকে নগদ সাহায্য দিতে হবে। এটা Social protection (সামাজিক সুরক্ষা) এর আওতায় অতিরিক্ত অর্থের যোগান দিয়ে এখনই করতে হবে। যাদের মজুরী/ বেতন বন্ধ হয়ে গেছে তাদের জন্য এটা করতেই হবে।
প্রাথমিকভাবে আগামী ছয় মাস ব্যাপী সকল অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে (unorganised বা informal sector) কর্মরত শ্রমিকদের নগদ অর্থ সাহায্য দিয়ে জীবনযাত্রায় সমর্থন দিতে হবে। এই খাতে ছয় মাসের জন্য দুই কিস্তিতে প্রথম তিন মাসের এবং পরবর্তী কিস্তিতে অবশিষ্ট টাকা নগদ প্রদান করা যেতে পারে। খাদ্য যোগান দিতে দুর্নীতি ও জটিলতা এড়ানোর লক্ষ্যে খাদ্যসামগ্রী না দিয়ে নগদ অর্থ প্রদানই শ্রেয়। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় সামরিক বাহিনীর অর্থ বিতরণ করবে। এ খাতে প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করতে হবে। ব্যাংকিং চ্যানেলে শ্রমিকদের স্ব-স্ব একাউন্টে কিস্তির নগদ টাকা পরিশোধ করতে হবে। জাতীয় পরিচয় পত্র এবং নিয়োগপত্র দেখে এদের চিহ্নিত করতে হবে।
গার্মেন্টস ও রফতানিমুখী শিল্প শ্রমিক শ্রেণিকে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে স্ব স্ব একাউন্টে প্রাথমিকভাবে তিন মাসের একটি নগদ অর্থ সাহায্য দিতে হবে। পরবর্তীতে তা আরও ৩ মাসের জন্য বৃদ্ধি করা যেতে পারে। অবশ্যি তাদের মালিকপক্ষদের এ টাকা বরাদ্দ না করে শ্রমিকদের ব্যাংক একাউন্টে এই টাকা জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে করে তারা আর্থিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবে। এ জন্য প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে।
গার্মেন্টস ও রফতানি শিল্প শ্রমিকদের ন্যয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় পরিচালিত শিল্প কারখানার শ্রমিকদেরকে জীবন যাত্রায় নগদ অর্থ সাহায্য দিতে হবে কেননা গার্মেন্টস শিল্পের মত এসব প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প-কারখানার শ্রমিকরাও একই দুর্যোগের শিকার। এদেরকে ৬ মাসের জন্য (প্রাথমিকভাবে ৩ মাসের জন্য এবং পরবর্তীতে আরও ৩ মাসের জন্য) নগদ অর্থ সাহায্য করতে হবে। খাদ্য যোগান দিতে দুর্নীতি ও জটিলতা এড়ানোর লক্ষ্যে খাদ্যসামগ্রী না দিয়ে নগদ অর্থ প্রদানই শ্রেয়। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় সামরিক বাহিনী অর্থ বিতরণ করবে। এ খাতে প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করতে হবে। ব্যাংকিং চ্যানেলে শ্রমিকদের স্ব স্ব একাউন্টে কিস্তির নগদ টাকা পরিশোধ করতে হবে। জাতীয় পরিচয় পত্র এবং নিয়োগপত্র দেখে এদের চিহ্নিত করতে হবে।
খাদ্য উৎপাদন যেন ব্যহত না হয় সে দিকে নজর দিতে হবে এবং বীজ, সার, কীটনাশক সেচ এবং ভূর্তকী সহ অন্যান্য সহযোগিতা এর কাজ চালিয়ে যেতে হবে এবং প্রয়োজনীয় অর্থ এখনই বরাদ্দ করতে হবে। এ অর্থ ব্যাংকিং এবং প্রশাসনিক চ্যানেলে সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষকসহ কৃষির সাথে সংশ্লিষ্টদের মধ্য বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে। এ খাতে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে।
আগামী এক বছরের জন্য পোল্ট্রিসহ সকল ধরনের কৃষি ঋণের কিস্তি ও সুদ মওকুফ করতে হবে।
সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত সকল ক্ষুদ্রঋণ এর কিস্তি আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত মওকুফ করতে হবে।
প্রবাসী শ্রমিকদের প্রেরিত রেমিটেন্স আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান পিলার। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে বাধ্য হয়ে কয়েক লক্ষ প্রবাসী শ্রমিক বাংলাদেশে ফিরেছেন। এ সমস্ত প্রবাসীদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। তাদের অনেকেই শূন্য হাতে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। এদেরকে চিহ্নিত করে প্রত্য প্রত্যেক প্রবাসীকে তিন মাসের জন্য মাসিক ১৫ হাজার টাকা আপদকালীন আর্থিক সাপোর্ট প্রদান করতে হবে, যাতে করে তারা যথাসময়ে পুনরায় বিদেশে স্বীয় কর্মস্থলে ফেরত যেতে পারেন। এ জন্য এ খাতে ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে।
স্বাস্থ্যখাত এবং যারা করোনা মোকাবেলার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত সেসব হাসপাতাল এবং সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রাথমিকভাবে ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে।
করোনা মোকাবেলার সঙ্গে যারা যুক্ত সে সকল ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবন ঝুঁকির বিবেচনায় জরুরী ভিত্তিতে তাদের স্বাস্থ্যবীমার ব্যবস্থা করতে হবে। আগামী তিন মাসের জন্য প্রতি চিকিৎসকদের জন্য ১ কোটি, নার্সদের জন্য ৭৫ লক্ষ এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ৫০ লক্ষ টাকার বীমার বিপরীতে প্রিমিয়াম সরকার বহন করবে।
করোনা চিকিৎসক, নার্স ও সংশ্লিষ্ট হাসপাতলে রোগীদের চিকিৎসার সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা সহকারীদের জরুরিভিত্তিতে দ্রুতগতিতে পিপিই, করোনা পরীক্ষার কিট ও আনুষঙ্গিক ঔষধ ও দ্রব্যাদি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
রাজধানী, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে করোনা রোগীদের জন্য পৃথক হাসপাতাল স্থাপন/ চিহ্নিতকরণ, পৃথক কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন এর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক/নার্সদের করোনা পরীক্ষা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও জরুরিভিত্তিতে পর্যাপ্ত জনবল নিশ্চিত করতে হবে।
দ্রুততম সময়ে করোনা ভাইরাসের টেস্টিং কিট দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে আমদানি ও উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে।
দ্রুততম সময়ের মধ্যে নতুন আইসিইউ স্থাপনের জন্য ভেন্টিলেটরসহ উন্নত চিকিৎসা সামগ্রী শুল্কমুক্ত আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রয়োজনে কমিউনিটি সেন্টার, কনভেনশন হল ও রাজধানীর বড় বড় শূন্য আবাসিক হোটেল গুলোকে সাময়িকভাবে হসপিটালে রূপান্তরিত করে জরুরী স্বাস্থ্য সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
প্রয়োজনে করোনায় আক্রান্তদের নদীতে ভাসমান জাহাজে আইসলেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা দেওয়া যেতে পারে। তাতে আক্রান্তের হার কমে আসবে।
বয়স্ক নারী, বিধবা, প্রতিবন্ধী, ষাটোর্ধ্ব বয়স্কদের আগামী তিন মাসের জন্য প্রতিমাসে জনপ্রতি ৫০০০ টাকা করে নগদ অর্থ বিতরণ করতে হবে। এ খাতে আপাতত ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে।
দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা পরিবারকে আগামী তিন মাসের জন্য বিনামূল্যে রান্নার গ্যাস/গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার সরবরাহ করতে হবে।
সাধারণ ছুটি ঘোষণার প্রেক্ষিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ গ্রামে চলে গেছে। গ্রামে তাদের কোন কর্মসংস্থান নেই। শাটডাউন চলতে থাকলে ঐ সময়ে বিপদগ্রস্ত এই জনগোষ্ঠীর মুখে খাবার তুলে দিয়ে এদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে এদের আপদকালীন ভাতা হিসেবে প্রাথমিকভাবে ১ মাসের জন্য মাথাপিছু ৫০০০ টাকা করে অর্থ প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে এ সময়সীমা বৃদ্ধি করতে হবে।
অবিলম্বে দেশের বরেণ্য অর্থনীতিবিদ সমন্বয়ে একটি আপদকালীন অর্থনৈতিক Task Force গঠন করতে হবে।
মধ্য-মেয়াদী পদক্ষেপ:
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কতিপয় পদক্ষেপ বিলম্বে হলেও নেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত কোন ঋণ গ্রহীতাকে ঋণ খেলাপী ধরা হবেনা। এই সময়কালীন ঋণের উপর কোনও সুদ আরোপ করা যাবেনা। সুদ মওকুফ করতে হবে। EMI (ঋণের নিয়মিত কিস্তি) পরিশোধ তিন মাসের জন্য স্থগিত করতে হবে। এ সময় শিল্প, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান Working capital এর Shortage হবে। সমস্ত ব্যাংকে Working capital দেয়ার জন্য নির্দেশনা দিতে হবে। নতুন করে Co-latral এর প্রয়োজন হবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এখনই ব্যাংক খাতে তারল্য বৃদ্ধি করার পদক্ষেপ নিয়ে ফিনানশিয়াল মার্কেটে আস্থা বৃদ্ধি করতে হবে। সম্প্রসারণশীল মনিটরিং পলিসি নিতে হবে। বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ১০% এর নীচে নেমে গেছে, এটা নুন্যতম ১৫%-১৬% এ উন্নীত করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের Policy rate, CRR, SLR, Repo এর rate কমাতে হবে, তবেই তারল্য বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংককে সকল বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে SLR এর সীমার উর্ধে রক্ষিত সকল treasury bill এবং treasury bond কিনতে হবে যাতে ব্যাংকের treasury bond বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশ ব্যাংককে ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্পের জন্য এবং বিশেষ করে দেশের জন্য ব্যবহৃত পণ্য প্রস্তুতকরী প্রতিষ্ঠানের জন্য re-finance করতে হবে। নুন্যতম ১০ হাজার কোটি টাকার ফান্ড তৈরী করে সর্বোচ্চ ৩% হারে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে হবে যেটা সর্বোচ্চ ৫% এ শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ঋন হিসাবে পেতে পারে।
ব্যবসায় অচলাবস্থার কারণে যেসকল SME অর্থ প্রবাহ সমস্যায় পড়েছে তাদেরকে সুনির্দিষ্ট রিলিফ-প্যাকেজ দিতে হবে। যেমন- আপদকালীন সময়ে SMEs গুলোকে কর-রেওয়াত দিতে হবে, ঋণ পরিশোধ স্থগিত রাখতে হবে। বিদ্যুৎ ও অন্যান্য বিল পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনে সেক্টরভিত্তিক সাবসিডি প্রদান করতে হবে।
SME গুলোকে এই দুর্যোগ মোকাবেলায় পৃথক credit line বরাদ্দ করে তাদের জন্য পর্যাপ্ত credit flow নিশ্চিত করতে হবে।
রাজস্বনীতি, অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সরকারের ব্যয় সংযত করতে হবে। অপচয় বন্ধ করে সেই অর্থ দিয়ে রপ্তানীমুখী শিল্প, ঔষধ শিল্প এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় শিল্পকে আর্থিক প্রনোদনা দিতে হবে। বিশেষ করে কর নীতির আওতায় কর্পোরেট কর এর হার কমানো, আপদকালীন সময়ের জন্য কর মওকুফ করা এবং ব্যক্তিগত এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এর নিকট হতে advance income tax আদায় করা বন্ধ করতে হবে।
সরকারি অর্থ সংকুলান করার জন্য এডিবি থেকে অপ্রয়োজনীয়, অনুৎপাদনশীল ও কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ দিতে হবে। অপচয় বন্ধ করতে হবে। কঠোর কৃচ্ছতা (austerity) অবলম্বন করতে হবে। মেগা প্রকল্প গুলোর অর্থ ব্যয় কিছুটা মন্থর করা যেতে পারে। সরকারের মন্ত্রী পরিষদ সচিব কতগুলো পদক্ষেপ ঘোষণা করেছেন প্রায় সবগুলোই শুধুই প্রশাসনিক পদক্ষেপ এবং জেলা ও স্থানীয় পর্যায়ে সরকারী কর্মকর কর্মকর্তাদের দায়িত্ব বন্টন। কোনও অর্থের বরাদ্দ নেই। এগুলো শুধুই কথামালা, বাস্তবায়ন হলেও কোন ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। সরকারকেই অর্থ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
কর্পোরেট সেক্টর এবং বড় বড় শিল্প খাতকে জাতীয় এ দুর্যোগ মোকাবেলায় অর্থায়নে এগিয়ে আসতে হবে, এটা তাদের সামাজিক দায়িত্ব (CSR) । এসময় বিভিন্ন মানব-হিতৈষী (philanthropic groups) গ্রুপ এবং এনজিও মানবসেবামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারেন। ইতোমধ্যে সীমিত আকারে হলেও বেসরকারি উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে যা উৎসাহ ব্যঞ্জক।
যে সব দেশে আমাদের প্রবাসী শ্রমিক রয়েছে এ্খনই সেসব দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে প্রবাসীদের চাকুরী সুনিশ্চিত করতে হবে। তাদেরকে যেন ছাটাই (Pay off) না করতে হয়।
মহামারীর পর সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়াতে হলে কৃষি ক্ষেত্রে সহায়তা জোরদার করতে হবে। আগামী মৌসুমে স্থানীয় বাজার থেকে কৃষক পর্যায়ে পর্যাপ্ত খাদ্য ক্রয় করে মজুদ করতে হবে। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন বিশ্ব মহামারীর কারণে খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ গুলো খাদ্য রপ্তানি করতে পারবেন কিনা সে সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নই। এ খাতে প্রাথমিকভাবে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে।
অসাধু ব্যবসায়ী মজুতদার ও দালাল শ্রেনীর লোকদের নজরদারিতে রেখে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা এবং উৎপাদন ও সরবরাহ-চেইন নির্বিঘ্ন রাখতে হবে।
অবিলম্বে সরকারকে বিশ্ব ব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ইসলামিক ডেভেলাপমেন্ট ব্যাংক ও IMF সহ দ্বি-পাক্ষিক আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে যোগাযোগ করে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে।
প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং gratuity জমা দূর্যোগকালীন সময় পর্যন্ত স্থগিত করতে হবে।
আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিকারি ব্যক্তিদের (self-employed) এবং start-up দের (job creators not job seekers) সব কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে তাদেরকে প্রাথমিকভাবে তিন মাসের জন্য আর্থিক সহায়তা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ব্যাংকিং চ্যানেলে মাসিক কিস্তিতে এ অর্থ প্রদান করতে হবে। এজন্য ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে। start-up এর সকল ধরনের কর পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে হবে।
শাটডাউনের কারণে কৃষক তাদের উৎপাদিত ফসল বাজারজাত করতে পারবে না। তাই উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ‘minimum support price’ নিশ্চিত করে দুর্যোগগ্রস্থ কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। খাদ্য প্রবাহ (food chain) যেন বন্ধ না হয়ে যায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন, স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার, তথ্য প্রবাহ ও জনমতামত তুলে ধরে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মীরা অনেক সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়িত্ব পালন করে আসছেন। করোনা-ভাইরাস মহামারীতে সংবাদকর্মীরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে যে আর্থিক প্যাকেজ পেশ করা হয়েছে তার অধিকাংশ যুক্তিসঙ্গত। দেশের এই ক্রান্তিকালে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সাংবাদিকদের আর্থিক ও অন্যান্য দাবীগুলো সুবিবেচনা করতে হবে।
দীর্ঘ-মেয়াদী পদক্ষেপ:
বাংলাদেশ ব্যাংক সকল ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অভিভাবক হিসেবে দেশের প্রধান আর্থিক শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান। সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারেনি। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংককে তাদের মৌলিক ভূমিকায় ফিরে এসে বিধ্বস্ত ও বিশৃঙ্খল অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যথাযথ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
এ জন্য আর্থিক, ব্যাংকিং ও কর ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার (reform) করতে হবে। স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী কাঠামোগত নীতি (structural policy) গ্রহণ করতে হবে।
ভবিষ্যতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে যারা বাস্তব কারণে দেশে ফিরতে বাধ্য হবেন তাদেরকে সহজ শর্তে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। যেন তারা আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে নিজের ও অর্থনীতির উন্নয়ন সাধনে লিপ্ত হতে পারে।
ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী অপ্রতিরোধ্য সংক্রামক রোগ ও মহামারীর কারণে রোগ নির্ণয় ও স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে বড় ধরনের ট্রান্সফরমেশন হয়েছে। এই পটভূমিকায় দেশে ইবোলা, ডেঙ্গু বা করোনা ভাইরাসের মত মহামারী মোকাবেলায় যথাযথ সক্ষমতা গড়ে তুলতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল, পরীক্ষা কীট, পিপিই, ভেন্টিলেটর, আইসিইউ ও আধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি সম্বলিত পর্যাপ্ত সংখ্যক পৃথক বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এরা যুদ্ধাবস্থার মত যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সর্বদা প্রস্তুত থাকবে।
দেশে ভবিষ্যতে সরকারি/বেসরকারি উদ্যোগে ভেন্টিলেটর নির্মাণ শিল্প গড়ে তুলতে হবে।
ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন তা বাস্তবায়নে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বিএনপি ঘোষিত ভিশন-২০৩০ মোতাবেক জিডিপির ৫% উন্নীত করতে হবে।
এসব সুপারিশগুলো জরুরিভাবে বাস্তবায়নের জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব।
সুত্র-যুগান্তর