‘কারনে অকারনে আমাদের অকথ্য ভাষায গালিগালাজ করে, কান ধরে উঠাবসা করিয়ে নেয়। প্রতিদিনই মারধর করে স্কুলের দুই শিক্ষিকা। প্রধান শিক্ষককে অভিযোগ করেও উপকার পাইনি। উপরন্ত প্রধান শিক্ষক আমাদের কথা বলতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। দুই শিক্ষিকার হাতে নির্যাতিত চোখ মুছতে মুছতে নির্যাতনের এমন বর্ণনা করছিলেন প্রাথমিক পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা।
এর আগে মেহেরপুর প্রতিদিনে অভিযুক্ত দুই শিক্ষককে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিলো যা লিঙ্কে গাংনীতে দুই সহকারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ
বলছিলাম, গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে বিচার চাইতে আসা মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার বাঁশবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কথা।
আজ মঙ্গলবার (১অক্টোবর) দুপুরে গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে দলবেধে বিচার চাইতে আসে বাঁশবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেনী থেকে পঞ্চম শ্রেনীর প্রায় অর্ধশত কমলমোতি শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীরা জানায়, বাঁশবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমরা। আমাদের স্কুলের শিক্ষিকা সাম্মিয়ারা দিপ্তী ও মোছাঃ রুহিনা খাতুন শ্রেনী কক্ষে আসার সময় হাতে ছড়ি নিয়ে আসেন। আমাদের বিনা কারনে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেন। কান ধরে উঠাবসা করিয়ে নেয় এবং প্রতিনিয়ত মারধর করে। আমাদের অনেক জোরে জোরে মারে। তখন আমাদের চোখের পানিতে বুক ভেসে যায়। সাম্মিয়ারা দিপ্তী ও মোছাঃ রুহিনা খাতুন স্যার ক্লাসে এসে চেয়ারে বসে শুধু ঘুমাই। কেউ কথা বল্লেই আমাদের মানসিক ও শারীরীক নির্যাতন করে। প্রধান শিক্ষককে বিষয়টি আমরা একাধিকবার জানিয়েছি । প্রধান শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বল্লে তাকেও ওই শিক্ষক সাম্মিয়ারা দিপ্তী ও মোছাঃ রুহিনা খাতুন প্রধান শিক্ষককে গালিগালাজ করে। আজ মঙ্গলবার সকালেও আমাদের বিনা কারনে গালিগালাজ করেছে, আমাদের বাবা মায়ের নামে আজেবাজে কথা বলেছে। আমরা সকল শিক্ষার্থীরা এক কিলোমিটার পায়ে হেটে ওই দুই শিক্ষিকার বিচার চাইতে এসেছি। ইউএনও স্যারের কাছে। ইউএনও স্যার আমাদের বিচার না করলে আমরা কেউ ঘরে ফিরে যাবনা। আমাদের আসতে দেখে উপজেলা নির্বাহী অফিসার উপর থেকে নেমে আসেন এবং আমাদের সভাকক্ষে বসিয়ে মনযোগ সহকারে আমদের কষ্টের কথা শোনেন।
প্রথম শ্রেনীর শিক্ষার্থী তাসমিম বলে, সাম্মিয়ারা দিপ্তী ম্যাডাম আমাকে কান ধরে টান দেয় এবং ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। এতে আমি পায়ে খুব আঘাত পেয়েছি। দ্বিতীয় শ্রেনীর শিক্ষার্থী মুন্না বলে,ম্যাডাম আমাকে ডাস্টার দিয়ে মাথায় মেরেছে। চতুর্থ শ্রেনীর শিক্ষার্থী আছিয়া খাতুন বলে,ওই দুই ম্যাডাম ক্লাসে এসে আমার বাবা ও মায়ের সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলে। পঞ্চম শ্রেনীর শিক্ষার্থী দোয়ামনি বলে, আমরা কোন দোষ করিনি তবুও আমাদের মারধর আর গাল দেয়। পঞ্চম শ্রেনীর শিক্ষার্থী সাবিহা, তৃতীয় শ্রেনীর শিক্ষার্থী সাদিয়া বলে, ওই দুই ম্যাডাম ক্লাসে এসে টেবিলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে যায়। কেই একটু কথা বল্লেই আমাদের হাতে ও পিঠে ছড়ি দিয়ে মারেন। শুধু মারনই না ওই দুই শিক্ষক মাসে দুই -একদিন স্কুলে আসেন, হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে চলে যান এমন অভিযোগ তোলেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের দেখে হতবাক হয়ে পড়েন উপজেলা নিবাহী কমকর্তা। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ শুনতে অফিস থেকে নেমে সভাকক্ষে বসেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রীতম সাহা। গাংনী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নাসিরুদ্দিন, নির্বাচন কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম, ক্লাস্টার অফিসার মোঃ আলাউদ্দিন, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোছাঃ নুরুন্নাহার এসময় উপস্থিত ছিলেন।
সভাকক্ষে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রীতম সাহা সকল শিক্ষার্থীদের কথা শুনছেন। শিক্ষার্থীরা শিক্ষক কর্তৃক তাদের নির্যাতের বর্ণনা করছে। শিক্ষকের তাৎক্ষণিক বিচার চেয়ে অনড় শিক্ষার্থীরা।
বর্ণনা শুনে তাৎক্ষনিক ভাবে প্রধান শিক্ষককে তলব করে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থিত করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। শিক্ষার্থীদের মুখে নির্যাতনের বর্ণনা শুনে হতবভম্ব হয়ে পড়েন কক্ষে থাকা সকলেই। পরিস্থিতি সামলাতে অভিযুক্ত শিক্ষক সাম্মিয়ারা দিপ্তী ও মোছাঃ রুহিনা খাতুনকে ওই বিদ্যালয় থেকে অন্যত্র সংযুক্তি করা হয় এবং তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। পরে শিক্ষার্থীরা শান্ত হলে সকল শিক্ষার্থীকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একটি বাস যোগে আবারও বিদ্যালয়ে রেখে আসেন।
জানাগেছে, ১৯৩৩ সালে বাঁশবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয়ে মোট ৬জন শিক্ষক রয়েছে। প্রধান শিক্ষক মোছা: নুরুন্নাহার যোগদান করেন ১৯৯৫ সালে, শিক্ষক তহমিনা খাতুন ১৯৯০ সালে, ফারহানা লাইলি ২০০৮ সালে, মাজহারুল ইসলাম ২০০৮ সালে, সাম্মিয়ারা দিপ্তী ২০১০ সালে এবং রুহিনা খাতুন যোগদান করেন ২০২০ সালে। বিদ্যালয়ে বর্তমানে মোট শিক্ষার্থী রয়েছে ১৪৫জন।
শিক্ষার্থী অভিভাবক রিপন আলী ও গোলাম মস্তফা বলেন, মাঝে মধ্যেই আমার মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি যায়। পরের দিন আর স্কুলে আসতে চাইনা। মাঝে মধ্যে রাতে ঘুমের মধ্যেও মারছে মারছে বরে চিৎকার করে ওঠে। আমরা ওই শিক্ষকের বিচার চাই।
প্রধান শিক্ষক মোছা: নুরুন্নাহার বলেন, আমি এর আগেও শিক্ষার্থীদের মারধর করা নিয়ে ওই দুই শিক্ষককে নিষেধ করি। পরে তারা আমার সাথেও মারমুখি আচরণ করে। এবং বিভিন্ন খারাপ ভাষায় গালিগালাজ করে। আজকে শিক্ষার্থীরা নির্যাতনের শিকার হয়ে আমাকে কিছু না জানিয়ে বিচার চাইতে এসেছে।
গাংনী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো: নাসিরুদ্দিন বলেন, এর আগে একবার ওই দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল। আবারও তারা শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। প্রাথমিক ভাবে ওই দুই শিক্ষককে অন্যত্র সংযুক্তি করা হবে।
গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রীতম সাহা বলেন, আমি অফিসে একটি মিটিং করছিলাম। হঠাৎ সিসি ক্যামেরায় দেখি স্কুল ড্রেস পরে অফিসের নিচে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় অর্থশত শিক্ষার্থী । আমি মিটিং শেষ না করেই দ্রত নিচে নেমে আসি। তাদের কথা শুনি এবং তাৎক্ষণিকভাবে উক্ত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে ডেকে অভিযুক্ত দুই শিক্ষককে অন্যত্র বদলির ব্যবস্থাসহ তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। পরে ওই শিক্ষার্থীদের আমি সাথে নিয়ে স্কুলে পৌছে দিয়ে এসেছি। এবং শিক্ষার্থীদের যেন কোনরকম হয়রানী বা ভয়ভীতি দেখানো না হয় সে ব্যপারেও সতর্ক করা হয়েছে।