রাজনৈতিক শিষ্টাচার ভুলে ব্যক্তিগত আক্রোশের মধ্য দিয়েই নোংরা রাজনীতি শুরু হয়েছে গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগে। যার ফলে সাধারণ মানুষ ও নতুন প্রজন্ম রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে বলে আশঙ্কা করছেন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার ব্যক্তিরা।
সাম্প্রতিক সময়ে গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মেহেরপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামান খোকন ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গাংনী উপজেলা চেয়ারম্যান এম এ খালেক ও তাদের নেতা কর্মীদের জনসভায় অশালীন বক্তব্য দেওয়াকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে এ পরিস্থিতি।
জনসভায় হাজারও জনতার মধ্যে একে অপরের মধ্যে কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি করছেন এই শীর্ষ রাজনীতিবিদরা। এখন এই কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি রাজনীতি কেন্দ্রীক নয়, গড়িয়েছে ব্যক্তি ও পারিবারিক সদস্যদের পর্যন্ত। তাদের মৃত পিতা-মাতার চরিত্র নিয়েও বলতে শুরু করেছেন একে অপরে। জনসভায় নেতাদের অশ্রাব্য ও অশালিন বক্তব্যে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তৃণমুলের নেতা কর্মীরা।
বিশ্লেষণে জানা গেছে, গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগ মুলত ১৯৯৬ সাল থেকে কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। তৎকালীন মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসাব উদ্দীন মেহেরপুর-২ আসনের দলীয় মনোনয়ন পান। সে দলীয় মনোনয়ন মেনে না নিয়ে স্থানীয় নেতা কর্মীরা দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মকবুল হোসেনকে (টেলিভিশন মার্কা) প্রতিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাড় করিয়ে দিয়ে নৌকার বিরুদ্ধে ভোট করান। তখন থেকে বিভক্ত হয়ে পড়ে গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মকবুল হোসেন নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ আবারও বিভক্ত হয়ে পড়ে। সংসদ সদস্য মকবুল হোসেন গ্রুপ ও বর্তমান জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ খালেক গ্রুপ।
মকবুল হোসেন গ্রুপ ও সাধারণ সম্পাদক এম এ খালেক গ্রুপের মধ্যে দীর্ঘদিন যাবৎ চলেছে সংঘর্ষ, মামলা হামলা। এম খালেকের সাথে বর্তমান এমপি সাহিদুজ্জামান খোকন, বর্তমান উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মকলেছুর রহমান মুকুলসহ অন্যান্য নেতা কর্মীরা ছিলেন। দীর্ঘদিন যাবৎ মকবুল হোসেন গ্রুপ ও এম এ খালেক গ্রুপের মধ্যে সংঘাত ও দলীয় কোন্দল মামলা, হামলা চলছিল।
২০০৭ সালে গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহিদুজ্জামান খোকন ও সাধারণ সম্পাদক এম এ খালেক নির্বাচিত হন। ২০১৫ সালে মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে সাধারণ সম্পাদকের পদটি পান এম এ খালেক।
সর্বশেষ গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামান খোকন ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন। সাহিদুজ্জামান খোকন এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর পরই স্থানীয় যুবলীগ তাদের অফিসের সামনে এমপিকে রাজাকারপুত্র বলে একটি ব্যানার টাঙিয়ে দেই। এর পরেই পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে পড়েছে গাংনী আওয়ামী লীগ। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উত্তেজনা উৎকণ্ঠা। পক্ষে-বিপক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে একে অপর পক্ষের গীবত নিংড়ে দিচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলকে সামনে রেখেও উপজেলা যুবলীগ অফিসের সামনে গাংনীর এমপির নামে রাজাকারপুত্র হিসেবে ব্যানার টাঙানো হয়েছে। পরে ব্যানারটি নামিয়ে নেয়াও হয়।
ব্যানারে ‘এমপি খোকনকে কুখ্যাত রাজাকার পুত্র দুর্নীতিবাজ ও হাইব্রিডমুক্ত আওয়ামী লীগে নেতৃত্ব চাই বলা হয়। এব্যানার টাঙানোর পরপরই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে গাংনীতে।’ অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে গাংনী থানা পুলিশ ব্যানার টাঙানোর পরপরই শহরে অবস্থান নেয়।
এ প্রসঙ্গে মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও গাংনী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এমএ খালেক বলেন, এমপি সাহিদুজ্জামান খোকন যে পথে হেটেছে আমিও তার পাল্টা পথে হেটেছি। সাহিদুজ্জামান খোকন আমাকে ও আমার পরিবারকে ছোট করেছে কটাক্ষ করেছে। আমি তার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জবাব দিয়েছি। আমি তাকে একজন নেতা হিসেবে দেখিনি, এমপি হিসেবেও নয়। তার মধ্যে বেইমানী ছাড়া কিছুই নেই। তার শরীরে রাজাকারের রক্ত প্রবাহিত। তার সাথে আমার প্রতিদ্বন্দ্বীতা নেই। বরং এমপি খোকন তার স্ত্রীকে দিয়ে আমার সাথে সাধারণ সম্পাদকের দলীয় ভোট করিয়েছে।
এদিকে গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মেহেরপুর-২ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামান খোকন বলেছেন, ১৯৮৩ সালে ছাত্রলীগে যোগদানের মাধ্যমে আমার রাজনীতি শুরু হয়েছে। ১৯৮৬ সালে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি। ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে দলের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিলাম। ২০০১ সালে সংসদ নির্বাচনের সময় বিএনপির জেল-জুলুমের শিকার হয়ে ২৯টি মামলা ও ছয়বার জেলে যেতে হয়েছে আমাকে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে দল তাঁকে এমপি মনোনীত করেছে। দীর্ঘ ৩১ বছর আমি গাংনীতে নৌকার টিকিট নিয়ে এমপি হয়েছি। আমাকে যোগ্য হিসেবে দেখেই তৃণমুলের নেতা কর্মীদের মতামত নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের তত্বাবধানে আবার দল আমাকে গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে রেখেছেন। একটি পক্ষ আমার প্রতি ঈর্ষানিত হয়ে আমার বিরুদ্ধে ও আমার পরিবারের বিরুদ্ধে নানাভাবে কটাক্ষ করে আসছেন। আমাকে নানাভাবে উস্কানিমুলক কথা বলে থাকেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তৃণমূল নেতারা বলছেন, প্রায় দেড় দশক ধরে গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। এক পক্ষ অপর পক্ষের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থায় অবস্থান করছিল। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ খালেক ও সাবেক সাংসদ মকবুল হোসেনের কর্মীদের মধ্যে হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনা ঘটেছে অসংখ্যবার। বিভক্ত রাজনীতির উত্তাপ ছড়িয়েছে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা আওয়ামীলীগের কয়েকজন নেতা ও কর্মী জানান, আমরা এখন মুখ খুলতে পারবোনা। তবে এমপিকে বারবার উস্কানিমুলক কথা বলায় এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এর সমাধানও চান এসব নেতাকমীরা।
বামন্দী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বামন্দী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ওবায়দুর রহমান কমল বলেন, এ ধরণের পরিস্থিতি তৈরী হওয়ায় তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের উপর বিরাট প্রভাব ফেলছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর মেহেরপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ জাকির হোসেন বলেছেন, গাংনীর আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক এ পরিস্থিতি শান্ত করতে দলের নেতা কর্মীদের এক সাথে বসে সমাধান করা উচিৎ। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে এমনটি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে কথা হয় মেহেরপুর সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল আমিনের সাথে। তিনি মেহেরপুর প্রতিদিনকে বলেন, রাষ্ট্র ও সমাজের প্রগতিশীল উন্নয়ন চিন্তাভাবনা করায় রাজনীতির কাজ। একে অপরের ব্যক্তিগত আক্রমন করা রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বিরুদ্ধ। গাংনীর আওয়ামী লীগের রাজনীতি যেভাবে চলছে তাতে মানুষ রাজনীতি থেকে সরে আসবে। নতুন প্রজন্মও রাজনীতির প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে উঠবে। গাংনীর নেতাকর্মীদের এক অপরের প্রতি কটাক্ষ মন্তব্য ও ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে বেরিয়ে শিষ্টাচার মেনে রাজনীতি করার আহবান জানান তিনি।