ঝিনাইদহের মহেশপুর থেকে ফিরে: ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি গ্রামের নাম চাপাতলা। ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র ৪শ গজ দূরে এই এলাকা। সেই গ্রামের একটি মাঠে দার্জিলিংয়ের কমলা বাগান করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন রফিকুল ইসলাম নামের এক নার্সারী মালিক।
রোকন নার্সারীর সেই কমলা বাগানে ঢুকতেই দেখা গেলো অনেক মানুষের ভিড়। তার বাগানে গিয়ে দেখা যায়, মেন্ডারিন ও দার্জিলিং দুই জাতের কমলায় চোখ ছলছল করছিলো বাগানে আগত দর্শনার্থীদের।
কেউ ঘুরে ঘুরে দেখছেন, কেউ আবার সেলফি তুলছেন। তবে অনেক মানুষের ভীড় সামলাতে সেই বাগানে আবার সিসি ক্যামেরাও চালু করেছেন নার্সারী মালিক। তবে সেই বাগানের ফল ছেড়া নিষেধ থাকলেও আগত দর্শনার্থীদের কমলা খাওয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন তিনি।
সরেজমিনে সেই বাগানে গিয়ে দেখা যায়, বাগানের প্রায় গাছেই সবুজ-হলুদ কমলা ঝুলে আছে। দেখতেই খুব সুন্দর লাগছে। কমলা সাধারণত আমাদের দেশে চাষ খুবই কম। যেমন দেখতে আবার স্বাদে ও রসে টুইটুম্বর।
মহেশপুর উপজেলার চাপাতলা গ্রামের নার্সারী মালিক রফিকুল ইসলাম একই এলাকার আইনুদ্দীন মণ্ডলের ছেলে। বাগানে ঘুরতে ঘুরতে কথা হয় রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, ছোট নার্সারীর ব্যবসা ছিলো তার। দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে কষ্টেই দিন পার হতো।
সংসারের অভাব ঘোচাতে ধারদেনা করে বছর চারেক আগে ভারতের দার্জিলিং গিয়ে কমলা বাগান ঘুরে ঘুরে তিনি দার্জিলিং থেকে ফেরার সময় কিছু কমলা ও মাল্টার চারা কিনে আনেন।
এরপর আবার চাপাতলা গ্রামে অন্যের কাছ থেকে কয়েক বিঘা জমি লিজ নিয়ে সেই জমিতে তিনি কমলা ও মাল্টার চাষ শুরু করেন। তবে কয়েক বছর পরে আর তাকে পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। মাল্টার আর কমলার বাগান তাকে বদলে দিয়ে তার সেই দু:খ কষ্টের জীবন। এখন তিনি স্বচ্ছল। পরিবারের সকলের মুখে হাসি ফোটানোর পাশাপাশি আরও অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। তার বাগানে এখন কাজ করেন ১৫ জন শ্রমিক।
রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ হয়েছিল তার। এই জমি থেকে ১০ লাখ টাকার মাল্টা ও কমলা বিক্রি করেছেন। দার্জিলিংয়ের কমলা কেজিপ্রতি ১০০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। পাইকার ব্যবসায়ীরা বাগানে এসেই নগদ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যায়। এতে করে বিক্রিরও তেমন কোন ঝামেলা নেই।
চাষ সম্পর্কে তিনি বলেন, পাঁচ বছর পর একটি গাছ ফল ধরার জন্য পরিপূর্ণতা লাভ করে। প্রতিটি গাছ থেকে ১২-১৫ বছর পর্যন্ত ভালোভাবে ফল পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, দার্জিলিংয়ের থেকে তার বাগানের কমলা অনেক স্বাদের। তিনি মনে করেন, এ দেশেও কমলা চাষ ভালো হবে। তেমন মাটি ও আবহাওয়া আমাদের রয়েছে। তিনি এখন নিজেই এই কমলা গাছের চারা বিক্রি করছেন।
কুষ্টিয়া সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক থেকে ঘুরতে আসা শহীদুল ইসলাম ও নাদীরা কুমারখালী থেকে আকতার হোসেন বাবুল নামে এক দর্শনার্থী বলেন, পরিবার পরিজন নিয়ে এই কমলা বাগানের কথা শুনে এসেছি। দূর থেকে হলুদ কমলা দেখতে অনেক ভালো লাগছে। আমরা আগে ভারতের দার্জিলিংসহ বিভিন্ন দেশের কমলা বাগানের কথা শুনেছি, কিন্তু দেখিনি। এখন আমাদের দেশেই কমলা চাষ হচ্ছে। এটি খুব ভালো উদ্যোগ। আমরা পরিবার পরিজন নিয়ে এই বাগান পরিদর্শন করে অনেক ভালো লাগছে।
কুষ্টিয়া সরকারী বালিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নাদিরা খানম এসেছিলেন এই বাগান পরিদর্শনে। তিনি বলেন, সমতল ভূমিতে বাণিজ্যিকভাবে দার্জিলিং জাতের কমলার চাষ এবারই প্রথম। রফিকুলের বাগানে উৎপাদিত কমলা খেতে বেশ সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। আমরা দলবেধে এখানে এসেছি। বাগান দেকে আমরা আনন্দে আত্মহারা।
সেখানে কর্মরত জহির রায়হান নামের এক শ্রমিক বলেন, পড়ালেখা শেষ করে কোন চাকরি না পেয়ে এই বাগানে কাজ করছি। এখানে কাজ করেই আমার সংসার চলছে। আমার মতো আরও ১৫-২০ জন শ্রমিক এই বাগানে কাজ করে থাকে।
মহেশপুর উপজেলার সরুপপুর ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি অফিসার রবিউল কবীর পল্লব বলেন, আমি এবং বিভিন্ন ভিজিটর নিয়ে রফিকুল ইসলামের কমলার বাগান পরিদর্শন করেছি। সবাই বলছে, দার্জিলিংয়ের থেকে এই কমলা অনেক ভালো। আমরা জানতাম পাহাড়ি অঞ্চলে কমলা ভালো হয়। কিন্তু মহেশপুর উপজেলার এই বেলে-দোঁআশ মাটিতেও অনেক ভালো কমলা হয়েছে।
কমলাতে মাছি পোকা এড়াতে তাকে বেশি পরামর্শ দেওয়াসহ তাকে আমরা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরণের সহযোগীতার পাশাপাশি সহায়তাও করে থাকি।