ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুতে উই কেয়ার প্রকল্পের আওতায় ২৯ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ ও একটি মডেল বাজার নির্মাণের কাজ করছে যশোরের মাইনুদ্দিন বাশি লিমিটেড নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
সম্প্রতি সড়ক ও জনপথ বিভাগের ১৭ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে প্রতারণায় অভিযুক্ত এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি এবার ঝিনাইদহের কৃষকদের সর্বনাশ করতে মাঠে নেমেছেন। প্রকল্পের ৯২ কোটি টাকার বরাদ্দে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে হরিণাকুণ্ডুতে এই কাজ করছে ঝিনাইদহের রেজাউল নামের এক সাব ঠিকাদার। তিনি কাজের শুরুতেই সর্বনাশ করেছেন শত শত কৃষকের।
কৃষকদের বোঝানো হয়েছে সরকারের নির্দেশে তারা আবাদি জমি থেকে মাটি কেঁটে নিচ্ছে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সরকারের প্রতি ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবাদি জমি রক্ষায় সকল ধরণের কাজ করছেন। কৃষকদের কথা চিন্তা করে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছেন। কৃষিতে আগ্রহী করতে প্রণোদনা দিচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা কার কাছে অভিযোগ দেবে সেই জায়গাও খুঁজে পাচ্ছে না।
প্রকল্পে হরিণাকুণ্ডু-সাধুহাটি ১০.৫ কিলোমিটার সড়ক, হরিণাকুণ্ডু জিসি পায়রাডাঙ্গা ৬.৫ কিলোমিটার সড়ক, হরিণাকুণ্ডু-নারায়ণকান্দি ১০ কিলোমিটার সড়ক, ভবানীপুর-ভেড়াখালি ১.৭৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ ও ভবানীপুর বাজারে একটি মডেল মার্কেট নির্মাণ করা হবে। মোট ২৯ কিলোমিটার সড়কের ৫.৫ মিটার কার্পেটিং ও ১.৮২ মিটার সোল্ডারিংসহ মোট ৭.৩২ মিটার বা ২৪ ফিট চওড়া হবে। হরিণাকুণ্ডু জিসি পায়রাডাঙ্গা ৬.৫ কিলোমিটার সড়কের সোল্ডারিংয়ের কাজ ইতোমধ্যে শেষ করেছেন ঠিকাদার। এই কাজ করতে এই সড়কের দুপাশ দিয়ে কয়েকশত কৃষকের সর্বনাশ করেছেন তারা।
সরজমিনে যেয়ে দেখা যায়, এই মাঠে কৃষকরা বোরো ধানের আবাদ করেছেন। আবাদি জমি থেকেই মাটি কেটে নিয়ে সোল্ডারিং করেছেন ঠিকাদার। রাস্তার দুপাশ দিয়ে সাড়ে ৪ফিট গভীর খাল খনন হয়েছে এই মাটির চাহিদা মেটাতে। অনেক কৃষক বাধ্য হয়ে জমির অন্য অংশ থেকে মাটি কেটে জমি সমান করে আবারও ধানের চারা রোপন করেছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে খনন করা খালে ছেড়েছেন মাছ।
হরিণাকুণ্ডু গ্রামের ওমর আলীর ছেলে তাহাজদ্দির ১৫ কাঠা জমির ৩ কাঠা খালে পরিণত হয়েছে, ফতেহ আলীর ছেলে মতলেবের ১ বিঘা জমির ৪ কাঠা খালে পরিণত, পাশাপাশি আজাহার মন্ডলের ছেলে পটলা, আনিস, রহিম হাজি, শমসের মন্ডলের ছেলে মওলা আলী, একই গ্রামের হাকিম, ভবানীপুর গ্রামের শাহ আলম, হরিণাকুণ্ডু গ্রামের মৃত এবাদত মন্ডলের ছেলে আব্দুল মজিদ, ইশারত মন্ডলের ছেলে হারুন অর রশিদসহ এই সাড়ে ৬ কিলোমিটার সড়কের ধার দিয়ে কৃষকের আবাদি জমি থেকে মাটি কেটে সোল্ডারিং করা হয়েছে। অনেকের জমির টপসয়েল কেটে নেয়ার কারণে বোরো মৌসুমের ধানের আবাদই করতে পারেনি।
হরিণাকুণ্ডু গ্রামের মৃত এবাদত মন্ডলের ছেলে আব্দুল মজিদ বলেন, রাস্তার পাশে আমার ১৩ কাঠা জমি। ধান লাগানোর পরে প্রায় আড়াই কাঠা জমিতে সাড়ে ৪ ফুট গভীর খাল খনন করে রাস্তায় মাটি দিয়েছে। আমার আড়াই কাঠা জমি নষ্ঠ হয়েছে। বাধ্য হয়ে এখন খালে তেলাপিয়া মাছের পোনা ছেড়েছি।
এই গ্রামের ওমর আলীর ছেলে তাহাজদ্দিন বলেন, আমার ১৫ কাঠা জমিতে ধান লাগানো ছিলো। ভেকু মেশিন দিয়ে কাউকে কিছু না বলেই ৩ কাঠার বেশি জমিতে খাল খনন করে রাস্তায় মাটি দিয়েছে। মাটি কাটার খবর পেয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলে ভেকু ড্রাইভার বলে সরকারি রাস্তার মাটি লাগবে দিতেই হবে। ইশারত মণ্ডলের ছেলে হারুন অর রশিদ বলেন, আমার প্রায় ৭ কাঠা জমিতে মাটি কেটে বড় গর্ত করে ফেলেছিল। পরে আমি আবার ভেকু ভাড়া করে নিয়ে এসে আমার পার্শ্ববর্তী জমি থেকে মাটি কেটে সমান করে ধানের চারা রোপন করেছি। আমাদের কোন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়ণি।
মাঠে উপস্থিত কৃষকরা জানালেন, এই মাঠে হরিণাকুণ্ডু উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম শিলুর জমি রয়েছে কয়েক দাগ। তার একটি জমি থেকে মাটি কাটলেও সে এসে ঠিকাদারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ নিয়ে অন্য জায়গা থেকে মাটি কেটে জমি সমান করেছে। সে প্রভাবশালী হওয়াই তার অন্য জমি থেকে মাঠি কাটেইনি। যেকারণে পার্শ্ববর্তীর জমির মালিকরা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এই বিষয়ে হরিণাকুণ্ডু উপজেলা প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান বলেন, সিডিউলে স্থানীয় সোর্স থেকে মাটি কাটার কথা বলা আছে তবে সেটা ঠিকাদরকে সমঝোতা করে নেওয়ার কথা বলা আছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক মাইনুদ্দীন বাশীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। বলা হয় সাব ঠিকাদার রেজাউলের সাথে যোগাযোগ করতে। রেজাউল ইসলামের কাছে কৃষকের আবাদি জমি থেকে মাটি কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইঞ্জিনিয়ারের সাথে কথা বলতে। ইঞ্জিনিয়ার সব জানেন। এই দিকে এই সড়কের পাশে জমি থাকা কয়েক গ্রামের মানুষ ও কৃষক এই ঘটনায় চরম নাখোশ হয়েছে। তারা আবাদি জমির ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। তারা দাবি করেছেন সরজমিন তদন্ত করার।
হরিণাকুণ্ডু উপজেলা প্রকৌশলীর অফিস কাজের বিষয়ে জানান, ২৯ কিলোমিটার সড়কের ১.৮২ মিটার সোল্ডারিংয়ের জন্য অবশ্যই স্টিমেটে একটা বড় অংকের খরচ ধরা হয়েছে। কিন্তু কিন্তু ঠিকাদার যদি কৃষকের আবাদি জমি ক্ষতি করে সেটা দুঃখজনক। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের এক কর্মচারী নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, রাস্তার পাশ থেকেই মাটি কেটে নেওয়াই মাত্র ৪/৫ লাখ টাকার ভেকু ভাড়া দিয়েই সোল্ডারিংয়ের কাজ করা হয়েছে সাড়ে ৬ কিলোমিটার রাস্তায়।
এই বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অদিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মনোয়ার উদ্দিন বলেন, এই প্রকল্প নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ পাচ্ছি। যদি কোন কৃষকের ক্ষতি করে থাকে তাহলে কাজ বন্ধ করে দেবো। আবাদি জমি থেকে মাটি কাটার কোন সুযোগ নেই। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক ও কৃষি বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাশে দাঁড়ানোর দাবি করেছেন। তারা বলেছেন প্রয়োজনে তাদের দাবি নিয়ে মানবন্ধন করবেন।