গত দুই দিনে বৃষ্টির দেখা না মিললেও আষাঢ়ের তৃতীয় দিন শুক্রবার (১৭ জুন) বিকাল থেকেই ঝরঝর মুখরিত বৃষ্টির সুশীতল পরশ পেলো মেহেরপুর জেলাবাসি। আজ শুক্রবার সকাল থেকেই আকাশে ছিলো কালো মেঘের ঘনঘটা। সেই ঘনঘটা থেকেই বিভিন্ন স্থানে বিকেলে বৃষ্টির দেখা পেলো জেলাবাসি। বৃষ্টি শুরু হলে প্রায় ঘন্টাখানে অবিরাম ঝুম বৃষ্টি যেনো গরমে নাকাল জেলাবাসি পেয়েছেন স্বস্তির পরশ।
দুই দিন পর যেন আষাঢ়ের তৃতীয় দিনটিকে বৃষ্টি দিয়ে বরণ করে নিল প্রকৃতি।
মেহেরপুর শহরের রিকসা চালক রহিম মিয়া জানালেন, আষাঢ় মাস দুই দিন হয়ে গেলেও বৃষ্টির দেখা মেলেনি। এই সময়ে গরমে শরীর হাঁসফাঁস করছিলো। আজকের এই স্বস্তির বৃষ্টি শীতল করে দিল প্রাণটা।
সঙ্গীত শিল্পী এসএম সেলিম রেজা বললেন,
আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে
পুবালী বাতাসে-
বাদাম দেইখ্যা, চাইয়া থাকি
আমার নি কেউ আসে রে।।
যেদিন হতে নতুন পানি
আসল বাড়ির ঘাটে
অভাগিনীর মনে কত শত কথা উঠে রে–
কিংবা রবী ঠাকুরের সেই আষাঢ়ের গানে ফিরে পাই বৃষ্টির পরশ,
“আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে,
আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে॥
এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি
নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে॥
রহিয়া রহিয়া বিপুল মাঠের ‘পরে নব তৃণদলে বাদলের ছায়া পড়ে।
‘এসেছে এসেছে’ এই কথা বলে প্রাণ, ‘এসেছে এসেছে’ উঠিতেছে এই গান–
নয়নে এসেছে, হৃদয়ে এসেছে ধেয়ে॥
মুখরিত হয়ে ওঠে মন। আষাঢ় আমাদের চিত্তকে হারিয়ে দেই গানের সেই অতল গহীনে।”
আষাঢ় বাংলা সনের তৃতীয় মাস। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে জুন-জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে এই আষাঢ় ।
আর আষাঢ় নামটি এসেছে পূর্বাষাঢ়া ও উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে।
আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল। আর বর্ষাকাল মানেই মেঘ, বৃষ্টি, প্রেম, নতুন প্রাণ, জেগে উঠার গান।
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তাই তো বলেছেন, ‘এই জল ভালো লাগে, বৃষ্টির রুপালি জল কত দিন এসে/ধুয়েছে আমার দেহ, বুলায়ে দিয়েছে চুল, চোখের উপরে/তার শান্ত স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে, আবেগের ভরে।’
বর্ষায় বাংলার নদনদী পূর্ণযৌবনা হয়ে উঠে। নদীর ফেঁপে উঠা জোয়ারের পানি প্রচুর পলি জমায় মাটিতে, যা নিয়ে আসে শস্যের প্রাচুর্যের খবর। এ সময় বিলে-ঝিলে ফোটে শাপলা-শালুক। হিজল আর কেয়াফুলের অরূপ দৃশ্য মোহিত করে মনকে।
বাঙালি মননে সবচেয়ে বেশি রোমান্টিকতা-আধ্যাত্মিকতার সুর বেজেছে এই বর্ষায়। বর্ষায় আবেগ ও অনুভূতির জোয়ারে ভাসেননি এমন কবি, সাহিত্যিক পাওয়া যায় না। শুধু যে কবি-সাহিত্যিক, তা নয়-সাধারণ মানুষও। কালীদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ বা নির্মলেন্দু গুণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে হুমায়ূন আহমেদ- কেউ বর্ষাকে এড়িয়ে যেতে পারেননি।
বর্ষাকাল গ্রামের মানুষকে অনেক বেশি ঘরমুখো করে তোলে। রমণীরা ঘরে বসে নকশিকাঁথায় ফুল তোলে। অনেকটা আলস্যে কেটে যায় দিন। বৃষ্টি বেশি হলে গরিব মানুষের হাতে কোনো কাজ থাকে না।
বর্ষায় ফোটে কদম ফুল, যা বর্ষার রূপকে বাড়িয়ে দেয় অনেক। ফোটে কেতকী। শহরের একঘেয়ে যান্ত্রিক জীবনেও বর্ষা প্রভাব ফেলে। বৃষ্টি শহরের ধুলোবালিকে বশ করে। তবে বর্ষায় শহরের রাস্তাঘাট অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায়, যা মানুষের ভোগান্তি বাড়ায়। অতি বর্ষণে দেখা দেয় নদীভাঙন ও বন্যা।
তবুও বর্ষা বাঙালি জীবনে নতুনের আবাহন। সবুজের সমারোহে, মাটিতে নতুন পলির আস্তরণে আনে জীবনেরই বারতা। সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা বাংলা মায়ের নবজন্ম এই বর্ষাতেই। সারা বছরের খাদ্য-শস্য-বীজের উন্মেষতো ঘটবে বর্ষার ফেলে যাওয়া অফুরন্ত সম্ভাবনার পলিমাটি থেকে।