পদ্মা সেতু ও পদ্মা রেল সেতুর মাধ্যমে সড়ক ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলপথে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। এরইমধ্যে বাংলাদেশ মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর এবং চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের আধুনিকায়নের মাধ্যমে সমুদ্রযোগাযোগেও নতুন দিগন্তের দেখা পেয়েছে। সর্বশেষ ঢাকা বিমানবন্দরের আধুনিকায়নের মাধ্যমে বিমান যোগাযোগের ক্ষেত্রেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বার বার বলেছেন, বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতির হাব। ভৌগলিকভাবে ভারত, চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মাঝামাঝি হওয়ায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের সাথে যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে বাংলাদেশ। এই অবস্থানগত সুবিধা অর্থনৈতিক কার্যক্রমে রূপান্তরের জন্য সড়ক, রেল, নৌ এবং বিমান যোগাযোগ সমন্বিত হচ্ছে বাংলাদেশে। বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল সেই সমন্বিত উদ্যোগেরই অংশ।
আজকের এই ঝা চকচকে তৃতীয় টার্মিনালে ঢোকার আগে আমাদের জানা দরকার, কোথায় ছিলো শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। বিমান বন্দরের নথি বলছে, ২০০৬ সালে আজকের বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীর ছিলেন বিমান প্রতিমন্ত্রী। তখন পর্যন্ত বিমান বন্দরে সিডিউলের বিপর্যয় ছিল খুবই নিয়মিত ঘটনা। ২০০৬ এর ২৯ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি মাত্র এক সপ্তাহের বিমানের ৪১টি ডিসি-১০ ফ্লাইটের একটিও সময়মতো ছাড়তে পারেনি। এর মধ্যে মাত্র একটি ফ্লাইট অল্প বিলম্বে ছেড়েছিল। বাকি ৪০ টি ফ্লাইট অনেক দেরিতে। কোনটা বাতিল হয়ে গিয়েছিল। ওই একই সময় এয়ারবাস-৩১০ প্লেনের ১১৬টি ফ্লাইটের মধ্যে মাত্র ১৭% ফ্লাইট নিয়মিত সময় চলাচল করেছে।
আবার এর পরের সপ্তাহে যদি দেখি, তাহলে দেখবো, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি ডিসি-১০ প্লেনের ৬৭টি ফ্লাইটের মধ্যে মাত্র একটি ফ্লাইট সময়মতো ছেড়েছিল। এয়ারবাস প্লেন দিয়ে পরিচালিত ৯৬টি ফ্লাইটের মধ্যে মাত্র ১৬টি চলেছিল নিয়মিত সময়ে। ওই সময় একটানা ২১ দিন বিমানের ডিসি-১০ এর কোন ফ্লাইটই সময়মতো চলাচল করেনি।
আজ দেশি-বিদেশি ৩৩টি এয়ারলাইনস ফ্লাইট পরিচালনা করছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। একটি রানওয়ে ব্যবহার করে প্রতিদিন গড়ে ১৫০টি ফ্লাইট ওঠা-নামা করছে। ফলে প্রায় পিক আওয়ারে একই সময়ে একাধিক ফ্লাইট থাকলে টেক অফের জন্য উড়োজাহাজগুলোকে সিরিয়াল ধরে অপেক্ষা করতে হয়। অন্যদিকে ল্যান্ডিংয়ের অনুমতি না পেলে আকাশে গো অ্যারাউন্ড করতে হয়। এতে এয়ারলাইনসগুলোর জ্বালানি খরচ যেমন বাড়ে, তেমনি ফ্লাইট শিডিউল ঠিক রাখাও হয় মুশকিলের। বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বার্ষিক ৮০ লাখ যাত্রী পরিবহনের ক্ষমতা রয়েছে।
এই সময়ে বিমানবন্দরে যুক্ত হচ্ছে তৃতীয় টার্মিনাল। এতে থাকছে বর্তমানের চেয়ে ৩ গুণেরও বেশি যাত্রী এবং প্রায় দ্বিগুণ কার্গো ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা। এরইমধ্যে নতুন ৫৫ টি এয়ারলাইন যাত্রী পরিবহন সেবা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হয়েছে। ২ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান জানিয়েছেন,সরকারের মেগা প্রজেক্টগুলোর মধ্যে অন্যতম এই প্রজেক্ট সরাসরি আন্তর্জাতিক কমিউনিটির সাথে সম্পৃক্ত।
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ আরও জানায় তৃতীয় টার্মিনাল চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে বিদেশিদের যাতায়াত বাড়বে, পাশাপাশি বাংলাদেশিদের বিদেশে ভ্রমণ করা অনেক আরামদায়ক হবে। হিসাব অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে বিমানবন্দরে যাত্রী পরিবহন সংখ্যা বাড়বে প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে ৮০ লাখ যাত্রী সেবা নিশ্চিত করতে পারলেও, দেড় কোটি যাত্রী পরিবহনের জন্য বর্তমান বিমানবন্দর যথেষ্ট নয়।
এক সমিক্ষায় দেখা গেছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে আড়াই কোটিতে উন্নীত হবে যাত্রী পরিবহন সংখ্যা। এই অতিরিক্ত যাত্রীর পরিমাণ সামলাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং জাইকার যৌথ অর্থায়নে ২১,৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ডিসেম্বর ২০১৯ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এখন নতুন এই টার্মিনাল, ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার বিস্তৃত, যা বছরে ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রীদের পরিষেবা দেবে। যাত্রী হ্যান্ডলিং ক্ষমতা ৮০ লাখ থেকে ২ কোটিতে উন্নীত হবে। অতিরিক্তভাবে এই টার্মিনালে মোট ৩৭টি বিমানের জন্য অ্যাপ্রোন পার্কিং তৈরি হয়েছে, যা প্রায় ৫.৫ লাখ বর্গ মিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে।
বর্মানে বিমান বন্দর ৭,০০০ বর্গমিটার আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সটি বার্ষিক ৩ লাখ টন কার্গো আনলোড করে, এখন ৩৬,০০০ বর্গমিটার রপ্তানি কার্গো কমপ্লেক্স বার্ষিক প্রায় ৫.৫ লাখ টন কার্গো হ্যান্ডেল করবে। এছাড়াও, টার্মিনালে মেট্রোরেল এবং ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সাথে সরাসরি সংযোগসহ একটি আলাদা স্টেশন থাকবে। থাকছে আন্তর্জাতিক মানের লাগেজ হ্যান্ডিলিং ও যাত্রীদের জন্য বিশ্বমানের সুযোগসুবিধা। নতুন টার্মিনাল পুরোপুরি চালু হলে কর্মসংস্থান হবে ৬ থেকে ৭শ নতুন কর্মকর্তা আর কর্মচারি।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরের আদলে নির্মাণ হয়েছে এই তৃতীয় টার্মিনাল। ঢাকা কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে জাপানের মিত্সুবিশি ও ফুজিটা এবং কোরিয়ার স্যামসাং- এই তিন প্রতিষ্ঠান মিলে থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ করেছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায় ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর। প্রকল্পের মোট নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপানি সহযোগিতা সংস্থা জাইকা ঋণ হিসেবে দেয় ১৬ হাজার ১৪১ কোটি ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। বাকি ৫ হাজার ২৫৮ কোটি ৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
প্রকল্পে কিছু খাতে টাকা সাশ্রয় হয়েছে। এই টাকা দিয়ে সরকার তৃতীয় টার্মিনালের ১২টি বোর্ডিং ব্রিজের জায়গায় অতিরিক্ত আরও ১৪টি বোর্ডিং ব্রিজ নির্মাণ করেছে। এখন বোডিং ব্রিজের মোট সংখ্যা ২৬ টি। এখানে রয়েছে মোট ৩৭টি অ্যাপ্রোন পার্কিং। এর ফলে একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্ক করা যাবে। বিমানবন্দরে বর্তমানে ট্যাক্সিওয়ে আছে চারটি। নতুন করে আরও দুটি হাই স্পিড ট্যাক্সিওয়ে যোগ হয়েছে। রানওয়েতে উড়োজাহাজকে যাতে বেশি সময় থাকতে না হয়, সেজন্য তৈরি করা হয়েছে নতুন দুটি ট্যাক্সিওয়ে। এছাড়া পণ্য আমদানি ও রপ্তানির জন্য দুটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। থাকছে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য তিনতলা ভবন।
বেবিচকের তথ্যানুযায়ী, থার্ড টার্মিনালে ২৬টি বোর্ডিং ব্রিজের মধ্যে প্রথম ধাপে চালু করা হবে ১২টি। ফলে শুরুতেই ৫ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটার এলাকায় ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্ক করা যাবে। বহির্গমনের জন্য ১৫টি সেলফ সার্ভিস চেকইন কাউন্টারসহ মোট ১১৫টি চেকইন কাউন্টার থাকবে। এছাড়া থাকবে ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট কন্ট্রোল কাউন্টার এবং ৬৬টি ডিপারচার ইমিগ্রেশন কাউন্টার। আগমনের ক্ষেত্রে পাঁচটি স্বয়ংক্রিয় চেকইন কাউন্টারসহ মোট ৫৯টি পাসপোর্ট ও ১৯টি চেকইন অ্যারাইভাল কাউন্টার থাকবে। থাকবে ১৬টি ব্যাগেজ বেল্ট।
বহুরকম সুযোগ সুবিধার থার্ড টার্মিনালে ঢোকা এবং বের হ্ওয়ার জন্যে কোন ঝক্কিঝামেলা থাকছে না। কারণ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি লুপ থার্ড টার্মিনালের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। থাকছে মেট্রোরেলের সংযোগও। হাজি ক্যাম্পের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের জন্য থাকছে টানেল। টানেলটি বিমানবন্দরের কাছে মেট্রোরেলের স্টেশনের সঙ্গেও যুক্ত হচ্ছে। ফলে বিদেশ থেকে যেসব যাত্রী আসবেন তারা খুব সহজেই বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে পারবেন। আবার যারা বিদেশ যাবেন, তারাও রাজধানীর যানজট এড়িয়ে খুব সহজে বিমানবন্দরে পৌঁছাতে পারবেন।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।