একের পর এক আবাদি জমিতে ইটভাটা ও পুকুর খনন করায় মেহেরপুরের গাংনী এলাকায় ক্রমশ কমে যাচ্ছে আবাদি জমি। জমির শ্রেণি পরিবর্তনে সরকারি কোন দৃশ্যমান পদক্ষেপ না থাকায় জমির মালিকগণ যত্রতত্র পুকুর খনন ও ইটভাটা তৈরি করছেন। পকুর খননের নামে দুই ও তিন ফসলি জমি কেটে মাটি বিক্রির হিড়িক পড়েছে। পুকুর খননের নিয়ম না মানলেও প্রশাসনিক পদক্ষেপ না থাকায় যত্রতত্র পুকুর খনন করা হচ্ছে। অপরদিকে আবাদি জমি কমে যাওয়ায় আগামীতে খাদ্যশস্য সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশংকা করছে কৃষি বিভাগ।
গাংনী উপজেলা কৃষি অফিসের হিসেব মতে এ উপজেলায় বছর পাঁচেক আগে আবাদি জমি ছিল ২৮ হাজার ৫৬৬ হেক্টর। বর্তমানে এ জমি কমে দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ১১৪ হেক্টর। বিশেষ করে আমন ও সবজি আবাদের জমি ক্রমশ কমেছে। ইটভাটা নির্মাণ ও পুকুর খনন ছাড়াও যত্রতত্র বসতবাড়ি নির্মাণ করায় জমি কমছে বলে মতামত দিয়েছেন কৃষি বিভাগ।
সরেজমিনে গাংনীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও এলাকাবাসির সাথে আলাপ করে পাওয়া গেছে নানা তথ্য। যুগিরগোফা গ্রামের হাসেম আলী জানান, এ গ্রামের মুন্দাইল বিলে দেড়শ বিঘা জমি ছিল। গ্রামের সম্ভ্রান্ত ও ধনী অ্যালবার্ট বিশ^াস মাঠে ৩০ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করেন। পরে স্থানীয় খালের মুখ বন্ধ হওয়ায় অন্যান্যদের নীচু জমি জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। একসময় ওই জমির মালিকরা তাদের জমি পানির দরে অ্যালবার্ট বিশ^াসের কাছে বিক্রি করে দেন। এভাবে মাঠের সিংহভাগ জমিতে তিনি পুকুর কেটেছেন। অথচ ওই জমির দলিলে লেখা আছে ধানী জমি।
একইভাবে ষোলটাকা জোড়পুকুর বামন্দী ছাতিয়ানসহ বিভিন্ন এলাকায় আবাদি জমিতে পুকুর আর ইটভাটা তৈরি করা হয়েছে। অনেকেই বসতবাটি স্থাপন করছেন। পরিবারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবার যেমন বিভক্ত হয়ে পড়ছে তেমনি একেকজন জমির শ্রেণি পরিবর্তন না করেই গড়ে তুলছেন আবাস স্থল। আবার অনেকেই যাতায়াত সুবিধার জন্য ঘরবাড়ি নির্মাণ করছেন ফসলি জমিতে। এভাবেই কমছে আবাদি জমি। অনেকেই জমির শ্রেণি পরিবর্তনের বিষয়টি বোঝেন না।
সচেতন মহলের মতে, ধানী জমি বাড়ি, পুকুর ও বাগানের শ্রেণি থাকলেও ইটভাটার কোনশ্রেণি নেই। অথচ এ উপজেলায় অন্তত ৪২টি ইটভাটা রয়েছে। আর এ ইটভাটার মাটি যোগান দিতে অনেকেই আবাদি জমির মাটি বিক্রি করছে। এতে জমির উর্বরা শক্তি নষ্ট হচ্ছে। আবার অনেকেই ইটভাটায় মাটি বিক্রি করতে পুকুর খনন করছে। ফলে জমির মালিক বিনা খরচে পুকুর খনন করতে পারছে সেই সাথে পাচ্ছেন মোটা অংকের টাকা।
গাংনী উপজেলায় মাটি বিক্রির একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারা অনেকেই রাজনৈতিক ছত্রছায়াই অবস্থান নিয়ে মাটি বিক্রি চালিয়ে আসছে। হিন্দা গ্রামের সামসুদ্দিন ওরফে সামু’র ছেলে মফিজুল ইসলাম বিভিন্ন ইটভাটা মালিকের সাথে বাৎসরিক চুক্তির মাধ্যমে মাটি বিক্রি ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। বিভিন্ন ভাটামালিক তাকে প্রতি ট্রাক বাবদ একটি কমিশন নিয়ে থাকেন। তিন বছর যাবত ব্যবসা করছেন বলে জানান তিনি।
মাটি বিক্রি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ এমন কথা জানানো হলে তিনি বলেন জানি কিন্তু প্রয়োগ নেই তাই অনেকেই করছেন এ ব্যবসা। তিনি স্কেবিটর ভাড়া করে পুকুর খননের কাজ করেন।
গাংনী উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ শাহাবুদ্দিন আহমেদ জানান, বর্তমানে একই আবাদি জমিতে বহুমূখী শস্যের চাষ হওয়ায় ও উন্নত এবং উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল আবাদের কারণে খাদ্য ঘাটতি নেই। যেভাবে আবাদি জমির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে তাতে একসময় খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে চরমে। এখনই এর প্রতিকার হওয়া দরকার।
গাংনী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নুর-ই আলম সিদ্দিকী জানান, যে কোন লোক তার ইচ্ছা করলে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে জেলাপ্রশাসক বরাবর আবেদন করে অনুমতি নিতে হবে। অন্যথায় জেল জরিমানা হতে পারে। ইতোমধ্যে কয়েকজনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে অভিযান চালানো হয়েছে এবং জরিমানা করা হয়েছে। আগামীতেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মেহেরপুর জেলা প্রশাসক ড. মুনসুর আলম জানান, শুধু মেহেরপুরে নয়, সারা দেশেই ২% হারে আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। আবাসনসহ নানাভাবেই জমি কমছে। পুকুর খননে তেমন সমস্যা নেই তবে পুকুরের মাটি ইটভাটায় বিক্রি নিয়ে নানা সমস্যা। এ ব্যাপারে প্রশাসন কাজ করছে এবং আগামীতেও কাজ করবে।