কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেছেন, নিলা শুধু আমাদের কুষ্টিয়ার নয়, দেশের গর্ব। আজকের এই অনুষ্ঠানের মধ্যমনি নিলা আমাদের নারী সমাজের পথ প্রদর্শক। অবহেলিত নারী সমাজের আলোকবার্তা। নিলাকে অনুপ্রেরণা মনে করে কুষ্টিয়ার নারী ফুটবল এগিয়ে যাবে।
শনিবার কুষ্টিয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমি অডিটোরিয়ামে জেলা প্রশাসন ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার যৌথ আয়োজনে
সাফজয়ী বাংলাদেশি নারী ফুটবলার নিলুফা ইয়াসমীন নীলাকে নিজ জেলা কুষ্টিয়ায় সংবর্ধনা প্রদানকালে সভাপতির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
জেলা প্রশাসক আরও বলেন,আমার বিশ্বাস নারী ফুটবলে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশ। ‘আজ আমরা অনেক আনন্দিত এই কারণে যে যারা সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের সুনাম তুলে ধরেছেন তাঁদের দলের অন্যতম একজন কুষ্টিয়ার মেয়ে নিলুফা ইয়াসমিন নীলা। তাঁকে সম্মানিত এবং বরণ করতে পেরে আমরাও সম্মানিত বোধ করছি।’
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন, জেলা পুলিশ সুপার খাইরুল আলম, জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট অনুপ কুমার নন্দী এবং খুলনা বিভাগীয় ডিএফএ সভাপতি মকবুল হোসেন লাবলু, কুষ্টিয়া সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রাশেদুল ইসলাম বিপ্লব, প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক তৌহিদী হাসান প্রমুখ। মঞ্চে নিলার মা বাছিরণ খাতুনও উপস্থিত ছিলেন।
পুলিশ সুপার খাইরুল আলম বলেন, বাংলাদেশে ফুটবলে আবারও নবজাগরণ সৃষ্টি হবে এই নারী ফুটবলারদের মাধ্যমে। আমাদের মেয়েরা খেলা করুক এটা খুব কম পরিবার চাই। মনে করে যেসব মেয়েরা ফুটবল খেলে থাকে তাদের বিয়ে হবে না। এই ভেবে খেলাধুলা করতে দেয় না। তবে নীলার মা যে তাকে ফুটবল খেলার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, একটা সময় খেলাধুলা হতো, এখন অনেকেই খেলাধুলা করে না। তাদের মাঠে এনে খেলাধুলার প্রতি বেশি বেশি মনোনিবেশ করতে হবে বলেও জানান তিনি।
খুলনা বিভাগীয় ডিএফএ সভাপতি মকবুল হোসেন লাবলু তার বক্তব্যে বলেন, আমরা নীলার মতো আরও নীলাকে গড়ে তুলতে চাই। আমরা চাই তার মেধা ও ক্রীড়া নৈপুণ্য দেখিয়ে দলের সাথে থেকে ভালো খেলায় অংশ নেবে।
সংবর্ধিত হয়ে নিলা বলেন, কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন ও জেলা ক্রীড়া সংস্থা সংবর্ধনা দিয়ে আমাকে যেভাবে সম্মানিত করেছে তাতে আমি অভিভূত, পুলকিত। এই কুষ্টিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আমি উঠে এসেছি। আমার ফুটবলার হয়ে ওঠার পেছনে কুষ্টিয়া জেলা ক্রীড়া সংস্থা ছাড়াও স্মরণ করতে চাই প্রয়াত ফাত্তাহ ভাইকে। তার সার্বিক সহযোগিতায় আমি আজ বাংলাদেশ জাতীয় দলের খেলোয়াড় হতে পেরেছি।
এছাড়াও কুষ্টিয়াবাসী ‘আমাকে যে সম্মান দেওয়া হয়েছে তা থেকে আমি অনুপ্রাণিত। এই অনুপ্রেরণা নিয়ে দেশের মানুষকে আরও ভালো ফুটবল খেলা উপহার দিতে পারব।’
অনুষ্ঠান শেষে নিলার হাতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ এক লাখ টাকা এবং জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকার চেক তুলে দেওয়া হয়।
এরআগে দুপুরে কুমারখালী উপজেলার মীর মোশাররফ সেতু থেকে জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে বরণ করে নেওয়া হয় তাঁকে। পরে কুষ্টিয়া শহর প্রদক্ষিণ শেষে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানস্থলে আসা হয় তাকে। এরপর জেলা প্রশাসন ও জেলা ক্রীড়া সংস্থাসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা সম্মাননা স্মারক ক্রেষ্ট তুৃলে দেওয়া হয়।
সংবর্ধনা শেষে জেলা প্রশাসনের গাড়িতে কুষ্টিয়া পৌরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে নিজ বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয় সাফ শিরোপা জয়ী নারী ফুটবলার নিলুফা ইয়াসমিন নীলাকে।
প্রসঙ্গত, রিকশাচালক বাবা তার মাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় নিলুফার বয়স ছিল মাত্র আড়াই বছর ও তার ছোট বোন সুরভী আক্তারের বয়স তখন ছিল মাত্র দেড়মাস। সে সময় মা বাছিরন আক্তার দুই মেয়ে নিয়ে চোখে-মুখে অন্ধকার দেখেন। সাহস বুকে নিয়ে মা বাছিরন নিলুফারের নানা বাড়ি কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়া এলাকায় কুঠিপাড়া চরে আশ্রয় নেন। তিনি শহরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সামান্য বেতনে চাকরিও শুরু করেন।
মায়ের ইচ্ছে ছিলো মেয়ে দুটোকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। নিলুফা ছোট বেলা থেকেই খেলাধুলায় পারদর্শী ছিলেন। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই সে নানা খেলায় সাফল্য দেখিয়েছেন। উচ্চ লাফ, দৌড়সহ প্রায় সব ধরনের খেলায় পারদর্শিতায় নিলুফার মা বাছিরন মেয়েকে ক্রীড়াবিদ হিসেবে তৈরির ইচ্ছা পোষণ করেন। তিনি মেয়েকে উৎসাহ ও সাহস দিতে থাকেন। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে নিলুফাকে খেলোয়াড় বানাতে তার পরিবারকে নানা নেতিবাচক কথাও শুনতে হয়েছে।
কুষ্টিয়া শহরের চাঁদ সুলতানা স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করার পর মিরপুর উপজেলার আমলা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন নিলুফা। পরে খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি হন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।