মেহেরপুরের সাহিত্য ও সাংবাদিকতার প্রসঙ্গ আসলে অবধারিতভাবে আসে দীনেন্দ্রকুমার রায় (১৮৬৯-১৯৪৩) ও যতীন্দ্রমোহন বাগচী ( ১৮৭৮-১৯৪৮)-এর নাম। সমসাময়িকদের নিয়ে আলোচনায় অলক্ষে থেকে যায় আরও কয়েকটি নাম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রামগোপাল সান্যাল ( ১৮৫০ – ১৯২১)। তিনি একাধারে লেখক, সাংবাদিক ও শিক্ষক ছিলেন। শহর মেহেরপুর তাঁর জন্মস্থান, কৃষ্ণনগর ও কলকাতা ছিল তাঁর কর্মকেন্দ্র। মেহেরপুরের গদ্য সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ইতিহাসে তাঁকে বলা যায় পথিকৃৎ।
দীনেন্দ্রকুমার ও যতীন্দ্রমোহনের পাশাপাশি মেহেরপুর শহরে জন্মগ্রহণকারী লেখক ও বৈষ্ণব সাহিত্যের বিশেষজ্ঞ জগদীশ্বর গুপ্ত (১৮৪৬-১৮৯২), পদাবলী সংগ্রাহক, লেখক ও মাসিক ‘জ্যোৎস্না’ পত্রিকার সম্পাদক রমণীমোহন মল্লিক (১৮৬৬-১৯০৫), রাধাকা›তপুর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী নলীনীকান্ত চট্টোপাধ্যয়-স্বামী নিগমানন্দ (১৮৮০-১৯৩৫), গাঁড়াডোবে জন্মগ্রহণকারী মুন্সী শেখ জমিরুদ্দিন (১৮৭০- ১৯৩৭), এমনকি মেহেরপুর শহরের জমিদার, লেখক দীননাথ মুখোপাধ্যায় নাম উচ্চারিত হলেও রামগোপাল থেকে গেছেন আলোচনার বাইরে। মেহেরপুরের বাড়িবাঁকায় জন্মগ্রহণকারী কবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী ( ১৭৯১- ১৮৪৫)-কে নিয়ে আলোচনা হয়। মেহেরপুর শহরে বসবাসকারী কবি কৃষ্ণহরি দাস ( আঠারো শতক)-কেও আনা যায় আলোচনার পাদপিঠে। দীননাথ মুখোপাধ্যায় ( উনিশ শতক)-এর বই বই ‘জমীদারী বিজ্ঞান’-এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৮৬৬ সালে হুগলীর বুধোদয় প্রেস থেকে। কিন্তু তিনিই যে মেহেরপুরের লেখক ও প্রভাবশালী জমিদার দীননাথ মুখোপাধ্যায়, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না। মেহেরপুর শহরে জন্মগ্রহণকারী লেখক-সাংবাদিক দীনেন্দ্রকুমার রায় ছিলেন বসুমতি পত্রিকার সম্পাদক এবং করিমপুরের জামশেদপুরে জন্মগ্রহণকারী কবি-সাংবাদিক যতীন্দ্রমোহন বাগচী ছিলেন মানসী পত্রিকার সম্পাদক। মেহেরপুর শহরের বলরাম হাড়ি ( ১৮২৫-১৮৯০) সম্প্রদায়ের গানও থাকে আলোচনায়।
লেখক- সাংবাদিক রামগোপাল সান্যালের বিষয়ে জানা যায় অলক রায় সম্পাদিত রামগোপাল সান্যালের দুই খণ্ডে সম্পূর্ণ ‘রেমিনিসেন্স অ্যান্ড অ্যানিকডট অব আ গ্রেট ম্যান অব ইন্ডিয়া’ (১৮৯৪, ১৮৯৫)-এর সম্পাদকীয় ভ’মিকা থেকে। এতে রামগোপালের লেখক জীবনী তুলে ধরা দেয়া হয়েছে। গৌরাঙ্গগোপাল সেনগুপ্তের ‘সাংবাদিক- কেশরী হরিশচন্দ্র’ (১৯৬০) গ্রন্থে সেই তথ্য দিয়ে বলা হয়েছে, রামগোপাল সান্যালের জন্ম মেহেরপুর। ১৮৫০ সালের কয়েক বছর আগে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ঈশ্বরচন্দ্র সান্যাল। তাঁরা বাস করতেন নদীয়ার জেলা সদর কৃষ্ণনগরের গোয়াড়ি অঞ্চলে। কৃষ্ণনগরেই তাঁর লেখাপড়া। সেখান থেকেই এন্ট্রান্স ও এফ এ পাশ করেন। বিয়েও করেন কৃষ্ণনগরে। প্রখ্যাত রামতনু লাহিড়ীর ভাই শ্রীপদ লাহিড়ীর কন্যা মনমোহিনী দেবী তাঁর প্রথম স্ত্রী। মনমোহিনীর অকাল মৃত্যু হয়। এরপর রামগোপাল রাজুবালা দেবীকে বিয়ে করেন। তিনিও কিছুদিন পর মারা যান।
এরপর আর বিয়ে করেননি। সম্ভবত তাঁদের কোনো সন্তানও ছিল না। লেখাপড়া শেষে রামগোপাল স্কুলের শিক্ষকতা দিয়ে পেশাজীবন শুরু করেন। সেই সাথে মফস্বল সাংবাদিকতা দিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন। তিনি কৃষ্ণনগরের এ ভি হাই ইংলিশ স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। বিখ্যাত কবি ও নাট্যকার দিজেন্দ্রলাল রায় তাঁর ছাত্র ছিলেন। এ ভি হাই ইংলিশ স্কুলের পর তিনি চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া ও মোমজোয়ানি স্কুলে প্রধান শিক্ষক ছিলেন। শেষে উড়িষ্যার সম্বলপুর হাই স্কুলে যোগ দিয়ে শিক্ষকতাজীবন শেষ করেন। যৌবনে কৃষ্ণনগরে অবস্থানকালে তিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদপত্রে মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ১৮৮৩ সালের ৪মে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর অবিচারের প্রতিবাদে কৃষ্ণনগর শহরে তিনিই প্রথম প্রকাশ্য জনসভার আয়োজন করেছিলেন। বৃত্তি পরিবর্তনের অল্প দিনের মধ্যেই ১৮৯০ সাল বা তার কিছু আগে কলকাতার তালতলা অঞ্চলে একটি বাড়ি কিনে স্থায়ীভাবে কলকাতায় বসবাস এবং সেই সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সাংবাদিকতার বৃত্তি অবলম্বন করেন। প্রথম কয়েকবছর তিনি বেঙ্গলি পত্রিকার কর্মাধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেন। তারপর ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক পদে যোগদান করেন। এই পত্রিকার সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল এক দশক বা তারও বেশি। ১৯২১ সালে রামগোপাল সান্যাল মারা যান।
বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা রামগোপাল সান্যালের ছয়টি বইয়ের বিষয়ে খোঁজ পাওয়া যায়। এগুলো হলো- বাংলায় : ১. হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের জীবনী ( ১৮৮৭), ২. বাবু কৃষ্ণদাস পালের জীবনী ( ১৮৯০)। ইংরেজিতে:১. দ্য লাইফ অব দ্য অনারেবল ক্রিস্টোদাস পাল বাহাদুর সি.আই.ই (১৮৮৬), ২. হিস্টোরি অব দ্য সেলিব্রেটেড ক্রিমিনাল কেসেস অ্যান্ড রিজল্যুশন্স রেকর্ডেড দেয়ার অন বাই বোথ প্রভিন্সিয়াল সুপ্রিম গভর্নমেন্টস (১৮৮৮), ৩. আ জেনারেল বায়োগ্রাফি অব বেঙ্গল সেলিব্রেটিস বোথ লিভিং অ্যান্ড ডেড (১৮৮৮) ও ৪. রেমিনিসেন্স অ্যান্ড অ্যানিকডট অব আ গ্রেট ম্যান অব ইন্ডিয়া ( দুই খণ্ড Ñ ১৮৯৪, ১৮৯৫)। এসবই প্রধানত জীবনীগ্রন্থ।
এর মধ্যে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের জীবনী নিয়ে বাংলায় প্রথম লেখা কোনো বই। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৮২৪-১৮৬১) ছিলেন ‘হিন্দু প্যাটিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদক। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি নীলকরদের অত্যাচারের কথা তুলে ধরেন। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে বলা হয় ভারতীয় সাংবাদিকতার জনক।
লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক, ঢাকা।