পুরুষের বোবা কান্না প্রেক্ষিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন২০০০(সং২০০৩)
আজ মনটা ভিষন খারাপ। প্রিয় সহকর্মী, এস.আই আব্দুল কাদের ভাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি।
তাঁর খুব মুরগীর মাংস খেতে মন চেয়েছে। ওসি স্যার বাসা থেকে মুরগির মাংস রান্না করে এনেছেন কাদের ভাইয়ের জন্য। রাত ৮.০৫ মিনিটে বেতার যন্ত্র বুঝে নিয়ে ডিউটি শুরু করবো। বেতার কং আশরাফ ভাই খুবই মিষ্টভাষী একজন মানুষ। সালাম স্যারঃ আপনার কি স্পেশাল ৭১ ডিউটি স্যার?
আমিঃ হ্যাঁ, আশরাফ ভাই। কোন ম্যাসেজ আছে নাকি?
না স্যার তেমন কিছু না, ঐ কাদের স্যারের জন্য ওসি স্যার মুরগির মাংস দিয়েছে। যদি স্যার কস্ট করে একটু পৌছে দিতেন, স্যার। নিশ্চয় নিশ্চয়।
দেন দেন! স্যার, আর একটা ম্যাসেজ আছে। হাসপাতাল থেকে ফিরে আপনার এলাকার কিছু ত্রাণ আছে স্যার, পৌছে দিবেন। আপাতত এইটুকুই স্যার।
ছুটে চললো গাড়ি রাজার বাগের দিকে। অনেকদিন পরে মিরপুরের বাইরে যাচ্ছি। গাড়ি যতই গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছে ততোই যেন চেনা এই শহরটা বড় বেশি অচেনা মনে হচ্ছে। কোথাও কেউ নেই মাঝে মাঝে দুই একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি।
কখনো কখনো অত্যন্ত উদাসী বাইক আরোহী ছুটে চলেছে আপন গন্তব্যে ফাঁকা রাস্তাধরে। হঠাৎ দেখি রাস্তার ধারে মলিন মুখে এক ট্রাফিক কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের দিকে তাকাতেই কেন যেন মনে হলো জনশূন্য এই শহরে বেচারা বড় বেশি একাকিত্বে ভুগছেন। আর প্রিয় জনের প্রিয় স্মৃতি গুলো হাতড়াচ্ছেন।
আমি গাড়ির গ্লাসটা আর একটু নামিয়ে ড্রাইভার কিবরিয়া কে বললাম এই এটা কি বিজয় স্মরনী? জ্বি স্যার!
বিজয় স্মরনিতে আজ আর কোন সিগনাল নাই। নাই গাড়ির লম্বা লাইন। বার বার উচ্চস্বরে কানফাটানো হর্ন বাজিয়ে উচ্চ শিক্ষিত ভদ্রলোকের সেই দামি দামি গাড়ি থেকে শুনা যাচ্ছেনা ট্রাফিক পুলিশের উদ্দেশ্য দেওয়া সেই তির্যক গালি।
সেই ভদ্রলোক গুলো আজ পরিবার পরিজন নিয়ে নিরাপদে নিজ গৃহে অবস্থান করছে। কিন্তু আজো একপায়ে ঠাই দাড়িয়ে আছে, পরিবার পরিজন ফেলে বিজয় স্মরণীর মোড়ের সেই ট্রাফিক কনস্টেবল। এই সব ভাবতে ভাবতেই একসময় আমাদের গাড়ি পৌছে গেলো রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের গেটে। গেটে দ্বায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা জানালেন এখন কোন কিছু দেওয়া যাবে না।
তাদের অনেক অনুরোধ করলাম কিন্তু কিই বা তাদের করার আছে? তারাও তো নিয়মের বেড়াজালে বন্দী। ঘটনাটি ওসি স্যারকে মোবাইল ফোনে অবহিত করে আবারো রওনা করলাম থানার দিকে।
ফাঁকা রাস্তাদিয়ে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়ি। হঠাৎ দেখি রাস্তা জ্যাম। গাড়িথেকে নেমে জানতে পারলাম ত্রাণের দাবীতে স্থানীয়রা রাস্তা অবরোধ করেছে। মনে পড়ে গেলো মুরব্বিদের মুখ থেকে শোনা সেই কথাটি। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান বানতে হয়।
আমাদেরও ধান বানা শুরু হলো। শতাধিক জনতাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিলাম। ভুলে গেলাম সামাজিক দূরত্ব ও করোনার ভয়। আবারো ছুটে চলেছি থানার দিকে এতোক্ষণ বেতার যন্ত্রটার দিকে খেয়াল ছিলোনা। হঠাৎ দেখি বেতার যন্ত্রটি বেজে চলেছে।
ইকো ৭১! স্পেশাল ৭১! লোকেশন কোথায় স্যার? বললাম, থানার কাছাকাছি। একটা নাম্বার লিখেন স্যার। ৯৯৯ এর কল ব্যবস্থা নেন স্যার। প্রাপ্ত নাম্বার টিতে ফোন করে পরিচয় দিয়ে সমস্যার কথা জানতে চাইলাম। অপর প্রান্তথেকে এক ভদ্রমহিলা অত্যন্ত কর্কস কন্ঠে জানতে চাইলো আমি কোথায়?
আমি আমার অবস্থান জানিয়ে তার সম্যার কথা জানতে চাই। তিনি বললেন, তার স্বামী তার বাচ্চাদের মারধোর করছে। আমি ভদ্র মহিলাকে বললাম, আপনার বাচ্চা মানে কি, বাচ্চা কি আপনার স্বামীর না? বাবাতো বাচ্চাদের একটু শাসন করতেই পারে।
এখানে আমাদের কি করার আছে। তার পরে তিনি যেটা বললেন, তার স্বামী বাসার কোন খরচ দেই না। এইসব বিষয় নিয়ে আজ আমাকে ও আমার বাচ্চাদেরকে মারধর করেছেন। আমি ভদ্র মহিলাকে হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দেওয়ায় উনি খুব রেগে গেলেন। উনি আমাকে শুনাইতে ভুললেন না যে, উনার অনেক বড় বড় পুলিশ অফিসার আছেন।
ভদ্র মহিলার কথা শুনে আমার কেমন যেন সন্দেহ হলো আমি উনার স্বামীর মোবাইল নম্বর নিয়ে ফোন করে পরিচয় দিয়ে তার স্ত্রীর দেওয়া অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলাম।
ভদ্রলোক পেশায় একজন ডাক্তার। তার বাবাও একজন ডাক্তার ছিলেন। ভদ্রলোক বর্তমানে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকুরী করে। গত চারমাস তিনি বেতন পাননি। তারপরেও গত মাসে ৮৫,০০০/= হাজার টাকা স্ত্রীকে দিয়েছেন।
ভদ্রলোক অনবরত কেঁদে যাচ্ছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে জানালেন যে তিনি ১৯৯৫ সালে বিয়ে করেছেন। তাদের মেয়েটি এবার এইচ এস সি দিবে, আর ছেলেটি ক্লাস ফোরে পড়ে। বিয়ের পর থেকে তার স্ত্রী কখনোই বাবা মার সাথে থাকেন নি। তিনি যে গালি গুলো আমাকে শুনালেন তা অত্যন্ত অশ্রাব্য অশালীন যা লিখা সম্ভব না। তিনি আরো যেটা বললেন তাকে দুই দুই বার মেরে রক্তাক্ত করেছেন। তিনি লোক লজ্জার ভয়ে থানা পুলিশ করেন নি।
তার সাথে আমার আট মিনিট পয়তাল্লিশ সেকেন্ডের কথার মধ্যে পুরোটা সময় জুড়ে কেঁদেছেন আর বার বার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। পারিনি আমি তদন্ত করে তার কোন উপকার করতে। দিয়েছি শুধুই শান্তনা। পারিনি এরকম হাজারো পুরুষের কান্নার কোন জবাব দিতে। তাইতো বলি আইন হবে মানবের কল্যানে কেন তা হবে নির্যাতনের হাতিয়ার?
মেপ্র/এমএফআর