আমার কাছে মায়ের জন্য বিশেষ কোন দিন নেই। প্রতিদিনই মা ময়। শুধু আমার না, আমাদের পাঁচ ভাইবোনের কাছে প্রতিদিনই মা দিবস।
আমি তখন কোন ক্লাসে পড়ি মনে নেই। খুব বৃষ্টি পড়ছিলো। সেই ঝুম বৃষ্টির সাথে চোখের পানি মিলিয়ে আমি মায়ের কাছে হাজির। হাতে গোসল করানো বই খাতা। মা আমাকে একঝলক দেখলো তারপরেই নিজেকে মায়ের বুকের মধ্যে দেখলাম আমি। আমাকে সেদিন আমাদের শহরের বিরাট বড় মস্তানের ভাগ্নে রাস্তার পাশের ডোবাতে ফেলে দিয়েছিলো। শোনার সাথে সাথে আমার মা হাতে একটা লাঠি নিয়ে সেই ভাগ্নের সামনে হাজির। দু তিন ঘা দেবার পর ভাগ্নে আরো উত্তেজিত হয়ে থাকে তার মস্তান মামার ভয় দেখাতে থাকে। আহা!! হঠাৎ আমি আবিস্কার করলাম যে ভয় দেখানোর কান আমার মায়ের হাতে আর মুগ্ধ দর্শক হয়ে মায়ের পিছনে। আমরা হাজির সেই মস্তানের বাড়িতে। সেদিন নতমুখে সেই মস্তানকে মায়ের কাছে ক্ষমা চাইতে দেখেছি। আজো চোখ বন্ধ করলে আমার অসীম সাহসী মা আমাকে সাহস দেয়।
আমাদের বাসায় টিভি ছিলোনা। আমরা পাশের কোন এক বাসায় মাঝে মাঝে হানা দিতাম টিভি দেখার জন্য। কার্টুন ছিলো রানার খুব প্রিয়। রানা আমার ছোট ভাই। একদিন কার্টুন দেখার সময় বাসার মালকিন আমাদের মুখের উপর টিভি বন্ধ করে দিলেন। আমাদের মন খুব খারাপ। রানার মন খারাপ একটু বেশি। মালকিন টিভি বন্ধ করার পর আমাদের বলে ছিলেন নিজের বাসায় টিভি দেখতে। আমাদের টিভি নেই কেন এই কষ্টে রানার মন বেশি খারাপ ছিলো। মা শুধু আমাদের সবাইকে বুকের মধ্যে নিয়েছিলেন বলেননি কিছুই। পরদিন সকালে মা নেই। মা আসলো দুপুরের পর। বিরাট বড় একটা বাক্স নিয়ে। সেই বাক্সটা ছিলো আমাদের জন্য জাদুর বাক্স। বাসায় প্রথম ১৭ ইঞ্চি তানিন টিভির আগমন। আমরা ভাই-বোনেরা কোন কোনদিন দিনের বেলায় টিভি চালিয়ে বসে থাকতাম আর মাছি উড়া দেখতাম। আর মা লাগাতার আমাদের মন খারাপের সময়কে সুখের বানিয়ে দিতেন।
আমার বাবা বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। কলেজ শিক্ষক বাবার জীবনে যতোবার সংকট এসেছে আমার মা সেই সংকটে ঢাল হয়ে দাঁড়াতেন। সংকটের মধ্যে মধ্যে দিন কাটানো আমরা কতদিন দেখেছি ম সাহস দিচ্ছেন আব্বুকে। আর আমার বাবা সেই সাহসে সংকট জয় করছেন। তখন থেকেই মা আমাদের কাছে মুশকিলআসান।
আমার বন্ধুর মতোন মা অকালে প্রয়াত প্রেমিকার চিঠি, কার্ড যত্ন করে গুছিয়ে রাখতেন বাবার ড্রয়ারে যেটা আমার জন্য বরাদ্দ ছিলো। একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি তিনি একজনকে সাহস দিচ্ছেন, অভয় দিচ্ছেন সে যেন ভয় না পাই আর ভুল না করে সেই জন্য। আবার জীবিত প্রেমিকাকে ঘরে এনে ছেড়েছেন আমার থেকেও বেশি প্রেম দেখিয়ে।
কাজের কারনে প্রায় সারা দেশেই ঘুরতে হয় আমার। বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষের সাথে আমার মেশামিশি। কাউকে কাউকে আমি মা ডাকি আম্মা ডাকি। এই ডাকাডাকির স্বভাব আমার বেশ পুরাতন। একবার একজন আমার মায়ের কাছে নালিশ করলেন। বিষয় হলো আমার মা কেন এইসব সহ্য করে, কেন আমাকে কিছু বলেনা। কাকতালীয় ভাবে আমি সেদিন আমাদের ড্রয়িং রুমে আর মা তাঁর ঘরে। আমি বোধহয় একটু দ্বিধা জনিত উৎকন্ঠায়। আমি সেদিন যে উত্তর মায়ের মুখে শুনেছিলাম তা আজো কানে তোলা আছে, মনে গেঁথে আছে। মা সেদিন যে উত্তর দিয়েছিলেন, আমার ছেলে যদি কাউকে মা ডাকে আর তাঁর আদর যদি নিতে পারে তবে তো সেটা গর্ব। আপনি একবার ভাবেন আমার ছেলেটা কতজনের ছেলে হয়ে উঠছে। আবার দেখেন অন্যকে মা ডাকার কারনে আমার প্রতি তার ভালোবাস কমেনি বরং বেড়েছে অনেকগুন। আমি জানি -আমি একদিকে আর আমার ছেলের কাছে বাকি দুনিয়া একদিকে। তাই এটা নিয়ে আমার কোন আফসোস নেই বরং গর্ব আছে।………. মায়ের দেয়া এই উত্তরটা আমাকে সকল মায়ের সন্তান বানিয়েছে।
মায়ের কারনেই আজ এই করনাকালে আমরা অন্য মায়েদের পাশে দাঁড়াচ্ছি। এমন বন্ধু, মুশকিলআসান মায়ের জন্য কি শুধু একটা দিন চলে। তাই আমাদের কাছে মায়ের জন্য নির্ধারিত দিন নেই। আমাদের সকল দিনই মা দিবস। কোন মায়ের জন্য একটা দিন নির্ধারন করে দেওয়া তাঁকে কেমন যেন দুরের মানুষ বানিয়ে দেয়। সকল দিনই আপনার জন্য মায়ের মমতায় ভরে উঠুক। যারা মাকে হারিয়েছেন তারা সকল জীবিত মায়ের মধ্যে নিজের মাকে খুঁজে পাক। সকল মায়ের জন্য ভালোবাসা। আমাদের মায়েরা দীর্ঘজীবি হোক। অনেক ভালোবাসা মায়েদের জন্য…..
লেখক : উন্নয়ন কর্মী