রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। একজন বয়স্ক লোককে বলতে শুনলাম, ‘সেই দিন কি আর আছে? দুনিয়া বদলে গেছে।’ বললাম, ‘চাচা, সেই দিন দিনই আছে। সেই দুনিয়া দুনিয়াই আছে। শুধু মানুষগুলো বদলে গেছে।’
মুরব্বি চাচা কথাটা বড় আক্ষেপ করেই বললেন। চারিদিকে যেভাবে শুরু হয়েছে কিশোর কিশোরীদের চলা ফেরা তাতে এমন কথা বলা স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে। দিন দিন আমাদের কিশোর কিশোরীদের মধ্যে যেভাবে অপসংস্কৃতি ঢুকে যাচ্ছে তাতে ওদের নিয়ে দু’কথা না বলেও উপায় নেই। সংস্কৃতির চর্চা করতে গিয়ে অপসংস্কৃতি ঢুকে পড়ছে। দেখে দেখে শিখবে শিখুক। ভালো কাজ হলে আপত্তি নেই। কিন্তু মন্দটা নিয়ে কথাতো বলতেই হয়।
আমরা সকলেই সৌন্দর্য পছন্দ করি। তাই বলে এমন সৌন্দর্য চাই না, যে সৌন্দর্য আমাকে, আপনাকে বিপথে নিয়ে যাবে। সৌন্দর্য আবার বিপথে নিয়ে যায় কি করে? হ্যাঁ সে কথায় আসছি।
একজন মানুষের স্বভাব, মন-মানসিকতা কেমন হবে তা তার পরিবার, সমাজ, পরিবেশ, পোশাক-পরিচ্ছদ, বাবা-মায়ের শাসন-বারণ অনেকটা এগুলোর উপর নির্ভর করে। আপনার সন্তানকে আপনি যেভাবে গড়ে তুলবেন সে সেভাবেই গড়ে উঠবে। শিশুরাতো নরম তুলতুলে উপকরণ, যে ছাচে ফেলবেন সেটাই তৈরি হবে।
আমরা ছোটবেলায় সন্ধ্যার পর রাস্তায় বের হলে পাড়াতো চাচা, ভাইয়েরা বলতো, ‘ খোকা, সন্ধ্যার সময় বাইরে থাকতে নেই? বাড়ি যাও, পড় গিয়ে।’ তখন আর উপায় থাকতো না। তাদের সাথে তর্কবিতর্ক করার কোনো সুযোগ ছিল না। কারণ আমাদের শাসন করার অধিকার তাদেরকে দেওয়া হত। কিন্ত বর্তমান সময়ে সেই অধিকার খর্ব হয়েছে।
এখন ছেলেমেয়েরা বড়দের সাথে তর্কবিতর্ক করে। জোর করে কিছু বললে বরং অভিভাবকেরাই বলে, ‘আমার ছেলেমেয়েকে শাসন করার তুমি কে হে।’ আমি বলি কি, আমাদের অনেক কিছুই। আপনার অবাধ্য সন্তানের জন্য আমারটা যে নষ্ট হতে চলেছে।
ছেলে-মেয়েদের এই বেখেয়ালিপনা, বখাটে হয়ে যাওয়ার পিছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী অভিভাবকেরা।
রাতের বেলা চায়ের দোকনে সিনেমা দেখতে আসবে পথ দেখার জন্য ছেলেকে টর্চ লাইট কিনে দিতে দেখেছি আমি। এইতো সেদিনের কথা, সেলুনে গিয়ে দেখি আমার এক পরিচিতজন তার ছেলের মাথার চুলের কাটিং দিয়েছে বাটি কাট। আমি বললাম, ‘ছেলের চুল এভাবে কাটালে কেন?’ প্রতিউত্তরে বলল, ‘আশেপাশে এখন এই চলছে।’ আমি বললাম, ‘আশেপাশে কিন্তু এখন এমনও চলছে, বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসা, গায়ে হাত পর্যন্ত উঠানো। এসবগুলোর জন্যেও প্রস্তুত হও। তুমিই ওকে সব চলাচলি শেখাচ্ছো।’
আমাকে দিয়েই বলি। যখন সিনেমা দেখতাম তখন কল্পনায় নিজেকে সিনেমার নায়ক মনে করতাম। দেখা গেল সিনেমা চলাকালীন নায়কের মারপিট দেখে আমিও পাশের জনকে হঠাৎ দুম করে বসিয়ে দিয়েছি। অথবা সামনের চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছি দুমা দুম দু ঘুষি। নায়কের হাত-কপাল কেটে, ফেটে গেলে নায়িকা শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে বেঁধে দিতেন।
কিন্তু আমি গো বেচারা প্রতিক্রিয়া পেতাম বকুনি আর হাতের অসহ্য ব্যথা। এরপরও ক্ষান্ত হইনি। নায়কের মত হতেই হবে। এ জন্য দেখাদেখি চুল ছেটেছি, প্যান্ট কিনেছি ছেঁড়া ফাঁটা। এখন আমার মেজাজ মর্জি দেখে কে। আমিও নায়ক। হায় হায়, বাড়িতে এসে দেখি ভাত নাই। বুঝলেন না? যদি বলি হাড়িতে ভাত নেই, সেটাও ঠিক আবার যদি বলি সমাজে আমার কোনো মূল্য নেই সেটাও মন্দ বলা হবে না। কল্পনার নায়কের বাস্তবের এই হাল।
এমন ঘটনাও রহরহ ঘটছে, ভারতের নাটক সিনেমার সিরিয়াল দেখে ওসব চরিত্র নিজের মধ্যে কল্পনায় এঁকে নিজেকে ওমন পোশাকে সাজাতে বাধ্য করেছে পোশাক কিনে দিতে। হয় পোশাক দাও, না হয় বিষ দাও। এজন্যই বলছি, ছেলে-মেয়েরা যে পরিবেশের সাথে পরিচিত হবে সে নিজেকে সেভাবেই প্রস্তুত করতে চাইবে।
এসব ছেলেরাই আজকের গ্যাং কালচার গড়ে তুলছে। টিকটকের অমক ভাই তমক ভাই হয়ে উঠছে। এরা আজ উন্মুক্ত। ইচ্ছে মত চুলের কাটিং দেয়, রঙ করে, বাইক নিয়ে রোড শো করে। অপসংস্কৃতির চর্চা করে। ঘুরে বেড়ায়। নেশা করে।
আপনি হয়ত ভাবছেন, পরের ছেলে, আমার কী। আপনার অনেক কিছুই। আজ অথবা কাল আপনার সন্তান ওদের দেখানো পথেই হাটবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। তাই আজই সতর্ক হোন।
আপনার সন্তানের হাতে এড্রয়েড ফোন তুলে দিচ্ছেন? সে সারাদিন গেমস খেলে সময় পার করছে। লাখ টাকার বাইক কিনে দিচ্ছেন? রাস্তায় নায়কের মত হেলতে দুলতে চলতে চলতে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে।
অনেক অভিভাবককে বলতে শুনেছি, ‘কি করবো বলো, ওদের সাথে পারা যায় না।’ যখন ওদের সাথে পারা যেত ঠিক তখনি আপনি ইচ্ছে করেই ওদের কাছে হেরে গেছেন। তাই এখন আপনি হারতে বাধ্য হচ্ছে।
একটা কবিতার কথা মনে পড়ে গেলে।
‘‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’’
আমরা সকলেই এই কবিতাটা পড়েছি আর না হয় কারো কাছ থেকে শুনেছি নিশ্চয়। কুসুমকুমারী দাসের বিখ্যাত কবিতা ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতার প্রথম দু লাইন এগুলো। কবি বড় আক্ষেপ নিয়ে লিখেছিলেন এই কবিতা। সত্যিই আজ আদর্শ ছেলের বড়ই অভাব। কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবার ছেলে আজ নিতান্তই হাতে গোনা। আমরাও অপেক্ষায় আছি সেই ছেলের, যে ছেলে সিনেমার নায়ক না হয়ে সত্যিকারের নায়ক হবে; সৎ, নীতিবান ও দেশ প্রেমিক হবে।
চাইনে এমন অপসংস্কৃতি। আমরা বাঙালি। ওমন মর্ডান ছেলের চাইতে ঢের ভালো চাষার ছেলে। বাবার দেওয়া লাখ টাকার বাইকে চেপে রোড শো করা ছেলের চাই হাতে মোহন বাঁশি তুলে নেওয়া গরু মহিষের রাখাল ছেলে অতি উত্তম। যে কিনা মাঠ থেকে ফিরেই বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করবে খাবার খেয়েছে কিনা। চাঁদনি রাতে উঠানে বসে তুলবে ঝুমুর গানের সুর।
লেখক: মুহাম্মদ বরকত আলী ( শিশুসাহিত্যিক ও গল্পকার )