নব্বইয়ের দশক ও পরবর্তী সময়ে কোনো নাটক প্রচার হলে সেখানে বেশির ভাগ সময়ই মধ্যমণি থাকতেন পর্দার জনপ্রিয় তারকারা। পরিচালকদের নিয়ে তেমন আলোচনা শোনা যেত না। তবে ২৫ বছর আগে ভিন্ন ঘটনা ঘটে। সেই সময়ে নাটক নির্মাণ করে আলোচনায় এলেন এক তরুণ মুখ। শুরুতেই তাকে নিয়ে সমালোচনা। তিনি বাংলা নাটককে ছক-কষা ড্রয়িংরুমের ভাষা থেকে বের করেছেন।
শুধু ভাষাই নয়, যার কাজের পুরো চিত্রনাট্য নেই, তিনি কোনো ব্যাকরণও মানেন না। ‘নিয়ম ভাঙছেন’ বলে জোরেশোরে তার সমালোচনায় নিয়ম করে চলতে থাকে। অন্যদিকে কড়া সমালোচনা মধ্যেই মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী নামটি দর্শকদের কাছে হয়ে উঠতে থাকে তারকাদের মতোই আলোচিত। বলছি ছবিয়ালের এই প্রধান মানুষটির কথা। দেখতে দেখতে সেই ছবিয়াল পেরিয়ে গেল ২৫ বছর।
যিনি কবিতা লেখেন, তাকে যদি কবিয়াল বলা যায়, তাহলে যিনি ছবি বানান, তাকে ‘ছবিয়াল’ কেন বলা হবে না। এটাই বোধহয় ‘ছবিয়াল’ নামকরণের কারণ ছিল। নামকরণের ব্যাখ্যায় মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ‘বোধহয়’ শব্দটি ব্যবহার করলেন। কেন করলেন? তার উত্তর জানতে চাওয়া হয়নি। তবে আন্দাজ করা যায়, অনেক আগের কথা বলেই হয়তো এভাবে বললেন। তাহলে এখন জানতে চাওয়া, কত আগের? ২৫ বছর।
২৫ বছর বলতেই যেন হুড়মুড় করে স্মৃতির মুখ-বন্দি অনেকগুলো বাক্স এসে পড়লো ছবিয়াল ফারুকীর সামনে। তার হয়তো ইচ্ছে করছিল, সবগুলোর মুখ খুলে দিতে। কিন্তু তা সম্ভব না। তিলে তিলে গড়ে ওঠা ছবিয়াল, ভুল করে শিখতে শিখতে এগিয়ে যাওয়া ফারুকীর ২৫ বছরের গল্প সম্ভার এভাবে হুট করে শোনা বা বলা যায় না।
তবুও কিছু গল্প ও স্মৃতি নিজেদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ছবিয়ালের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাজধানীর তেজগাঁও-এ এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শনিবার (২৬ অক্টোবর) সন্ধ্যার এই আবেগঘন আয়োজনে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তো ছিলেনই, আরও ছিলেন ভাই-বেরাদররা অর্থাৎ তার সহকারী পরিচালকেরা, ছিলেন সেই সহকারী পরিচালকদের সহকারী পরিচালকরাও। এভাবে পরম্পরাকে সম্মান জানিয়ে এবং পরিবারের মানুষদের সঙ্গে নিয়ে সবাই মিলে অনন্দে কাটিয়েছেন সন্ধ্যাটি।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ব্রেইন-চাইল্ড ছবিয়াল। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যানারেই ২৫ বছর ধরে তিনি নির্মাণ করে আসছেন বিজ্ঞাপন, নাটক, সিনেমা। তারচেয়ে অধিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা, এই প্রতিষ্ঠান জন্ম দিয়েছে অনেক ছবিয়াল। যাদের আলোয় আলোকিত এখন বাংলাদেশ।
১৯৯৮ সাল, ছবিয়াল থেকে ফারুকীর প্রথম নির্মাণ ‘ওয়েটিং রুম’, সেই সময় কোনও টিভি চ্যানেল কিনতে চায়নি ফিকশনটি। ২৫ বছরে এসে চিত্র সম্পূর্ণ বদলে গেছে। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নামের আগে যুক্ত হয়েছে বিশেষণ। তিনি এখন অন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো সে স্বীকৃতি দিয়েছে তাকে।
সহজ ছিল না এ পথ, এখনও নেই। ছবিয়াল থেকে ফারুকীর সাম্প্রতিক নির্মাণ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ সিনেমাটি দেখলে তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। ফারুকী বলেন, ‘ছবিয়াল থেকে আমরা এমন সব সিনেমাই করতে চেয়েছি, যার মধ্যে বাংলাদেশর নিঃশ্বাস আছে।’
নিজস্বতা তৈরি করার এই চেষ্টাই অনন্য করে তুলেছে ছবিয়াল ও ফারুকীকে। শুরুর যাত্রায় ছবিয়াল ও ফারুকীকে অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য করেছেন। যাদের মধ্যে চ্যানেল আইয়ের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) ফরিদুর রেজা সাগর ও চ্যানেল ওয়ানের কর্ণধার গিয়াস উদ্দিন আল মামুন অন্যতম।
ছবিয়ালের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ফরিদুর রেজা সাগর বলেন, ‘ব্যাচেলর সিনেমা নির্মাণের সময় ফারুকীর সঙ্গে আমার পরিচয়। সেই ফারুকী এখন কোন পর্যায়ে আছেন, তা দর্শকরা ভালো করেই জানেন। ফারুকী শুধু চলচ্চিত্র নির্মাতাই নন, সমাজের সব কিছু নিয়ে তার রয়েছে বিচার-বিশ্লেষণ। তাই ফারুকীর সিনেমায় আমরা আপনাকে-আমাকে দেখতে পাই।’
ছবিয়ালের শুরুর দিকে চ্যানেল ওয়ান থেকে সিরিজ চাওয়া হয়েছিল। সিরিজ না করে ‘ছবিয়াল উৎসব’ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ফারুকী। সেই সময়ের কথা উল্লেখ করে গিয়াস উদ্দিন আল মামুন বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস ছিল, আমাদের দেশের তরুণরা অনেক সুন্দর এবং নতুন কিছু করতে পারে। যার জন্য চ্যালেঞ্জটা আমরা নিই এবং সফল হই।’
এর পাশাপাশি ছবিয়াল আরও একটি বিরল দৃষ্টান্ত রেখে গেছে দেশের মিডিয়াঙ্গনে। সেটি হলো ফারুকীর পাশাপাশি তরুণ নির্মাতা তৈরি করা। যারা একসময় সহকারী পরিচালক হিসেবে ছিলেন ছবিয়ালে, তারাই এখন নিজেদের নামে খ্যাতি অর্জন করেছেন। অনেকেই তাদের গুচ্ছ আকারে ‘ভাই বেরাদার’ নামে চেনেন। যাদের মধ্যে অন্যতম রেদওয়ান রনি, আশুতোষ সুজন, শরাফ আহমেদ জীবন, আশফাক নিপুণ, ইফতেখার আহমেদ ফাহমী, মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ, আদনান আল রাজীব প্রমুখ।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ‘ভাই-বেরাদার’ আশফাক নিপুণ বলেন, ‘আমার নির্মাণে সবসময় লেখা থাকে ‘বানিয়েছেন আশফাক নিপুণ’। আর সেই আশফাক নিপুণকে বানিয়েছে ছবিয়াল, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। আজ যা একটু করতে পারি তা ওই দুটি নামের জন্য।’
আরেক ‘ভাই-বেরাদার’ ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকির সিইও রেদওয়ার রনি বলেন, ‘ছবিয়াল আমার এবং আমার মতো অনেকের আতুর ঘর। ছবিয়াল নিয়ে অল্প কথায় বলা যায় না, কারণ এটা খুব ইমোশনাল জায়গা, ইমোশনাল জার্নি। ছবিয়াল কোনও প্রতিষ্ঠান নয়, এটা আশ্রম।’
২৫ বছরের পথচলায় অনেক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে ফারুকী ও ছবিয়ালকে। যার মধ্যে অন্যতম ভাষার ব্যবহার। নাটকে কথ্য ভাষার ব্যবহার করে সমালোচনার মুখে পড়েন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একসময় বুঝলাম অভিনয় মেকি লাগার অন্যতম কারণ ভাষা। আমি যেমন, সেভাবে যদি কথা না বলি, তাহলে সেটা মেকি মনে হবেই। তাই আমি চরিত্রের ধরণ অনুযায়ী ভাষার ব্যবহার করেছি। দর্শক সেটা গ্রহণ করেছে।’
ছবিয়ালের উল্লেখযোগ্য ফিকশন ও ধারাবাহিক নাটকের মধ্যে রয়েছ ‘আয়শা মঙ্গল’, ‘প্রত্যাবর্তন’, ‘কানামাছি, ‘চড়ুইভাতি’, ‘৬৯’, ‘৫১বর্তী’ ও ‘৪২০’। সিনেমার মধ্যে রয়ছে ‘ব্যাচেলর’, ‘টেলিভিশন’, ‘মেড ইন বাংলাদেশ’, ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’, ‘ডুব’ ও পিঁপড়াবিদ্যা’।
ছবিয়ালের ২৫ বছর পূর্তিতে দর্শকদের উদ্দেশে ফারুকী বলেন, ‘২৫ বছর দর্শকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বড় হওয়া। আমি তো মনে করি, আমার সিনেমাগুলো সময়ের সঙ্গে যেমন কথা বলে, তেমন দর্শকের সঙ্গেও কথা বলে এবং এই কথা বলার মধ্যে দিয়েই আমরা বড় হচ্ছি, বুড়ো হচ্ছি। দর্শকরা আমাদের না ভালোবাসলে প্রথম সিনেমার পরই ছিটকে যেতাম। তারা যেভাবে আমাদের পথটাকে সমর্থন করেছেন, সেজন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।’
উল্লেখ করা দরকার, ‘ডুব’ (নো বেড অব রোজেস) সিনেমাটি যে বছর বাংলাদেশ থেকে অস্কার প্রতিযোগিতায় গিয়েছিল, অর্থাৎ ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ম্যাগাজিন ভ্যারাইটির রিভিউয়ার ম্যাগি লি এমন এক বাক্য লেখেন যা বাংলাদেশর জন্য গর্বের। সিনেমাটিতে সুখ, একাকীত্ব ও মনস্তত্ত্বের প্রসঙ্গ টেনে তিনি মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে নিয়ে বলেন, ‘ফারুকী প্রমাণ করেছেন তিনি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের অনন্য কণ্ঠস্বর।’
যদিও সেই কণ্ঠস্বর বেশ ক’বার রোধের চেষ্টা ছিলো বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সুবাদে। যার শেষ চিহ্নটি এখনও পড়ে রয়েছে, বোর্ডের হিমঘরে, ‘শনিবার বিকেল’ নামে! পরিকল্পিত নয়, তবুও কী দারুণ মিলে যায়, সেই ২৬ অক্টোবর শনিবারের বিকাল গড়ানো সন্ধ্যায় ২৫ বছরের হিসাব নিয়ে যেন বসেছিলো ছবিয়াল আসর!
সূত্র: ইত্তেফাক