জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম আগ্রহ ও অগ্রাধিকারের জায়গা ছিল শিক্ষা খাত। স্বাধীনতার পরপরই দেশের ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে নানা উদ্যোগ নেন তিনি। অল্প সময়ের মধ্যেই প্রাথমিক শিক্ষার জাতীয়করণ, সংবিধানে শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, শিক্ষা কমিশন গঠন ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠাসহ শিক্ষার উন্নয়নে যুগান্তকারী বেশকিছু কর্মসূচি নেন বঙ্গবন্ধু। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারও সবসময় শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর মতো আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও শিক্ষায় ব্যয়কে বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখনই সরকার গঠন করেছেন তখনই শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোসহ সবকটি খাতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বিশেষ করে ২০০৯ সাল থেকে অদ্যাবধি—বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বাধীন সরকারের এ বছরগুলোয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে। চোখ ধাধানো উন্নয়ন সাধিত হয়েছে যোগাযোগ অবকাঠমোয়।
তুলনামূলক কিছু বিশ্লেষণ দেখলে বিষয়গুলো আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ২০০৯ সালে পাবলিক ও প্রাইভেট মিলে দেশে বিশ^বিদ্যালয় ছিল ৮২টি। এর মধ্যে ৩১টি পাবলিক ও ৫১টি প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয় ছিল। বর্তমানে দেশে বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৬টিতে। এরমধ্যে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৪টি ও প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয় ১১২টি। অর্থাৎ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে ১৪ বছরেরও কম সময় দেশে বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যা দ্বিগুন হয়েছে। এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কৃষি, চিকিৎসা, মেরিটাইম, অ্যারোস্পেস এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মতো বিশেষায়িত বিভিন্ন খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশে চিকিৎসা বিষয়ক একমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল মাত্র একটি। বর্তমানে দেশে মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫টি। একইভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি ও বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির মতো যুগোপযোগী উচ্চশিক্ষালয় গড়ে তুলেছে শেখ হাসিনার সরকার। শুধু নতুন বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নয়; উচ্চশিক্ষার প্রসারে পুরনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন নতুন বিভাগ অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
এসব শুভ উদ্যোগের সুফল হিসেবে গত কয়েক বছরে দেশের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থী প্রবেশের সুযোগ ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে অবিশ^াস্য হারে। ২০০৯ সালে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়সহ দেশের পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ১৪ লাখের নিচে। যা বর্তমানে বেড়ে ৩৬ লাখ ছাড়িয়েছে। একইসঙ্গে বেসরকারি খাতের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও শিক্ষার্থী বৃদ্ধির হার আশাব্যঞ্জক। ২০০৯ সালে দেশের বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় খাতে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ২ লাখ। বর্তমানে যা চার লাখের কাছাকাছি।
শুধু প্রতিষ্ঠান কিংবা শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংখ্যা নয়; সম্প্রতি বছরগুলোয় দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মানেও বেশ উন্নতি ঘটেছে। বর্তমানে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেশন জট প্রায় শূন্যের কোঠায়। উচ্চশিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিতকল্পে বর্তমান সরকার বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গড়ে তুলেছে। বিশ^বিদ্যালয়গুলোয় মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণা নিশ্চিত করতে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পের (হেকেপ) সফল বাস্তবায়ন করে সরকার। বর্তমানে হায়ার এডুকেশন অ্যাক্সেলেরেশন অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন (হিট) শীর্ষক আরো একটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন। বিশেষ বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি সরকার ধারাবাহিকভাবে গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে।
২০০৯-২০১০ অর্থবছরে গবেষণা খাতে সরকারের বরাদ্দ ছিল মাত্র ১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উচ্চশিক্ষায় গবেষণার জন্য সরকার ১৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। শিক্ষা ও গবেষণার মান বাড়ায় বৈশি^ক র্যাংকিংয়েও দেশের বিশ^বিদ্যালয়গুলোর অবস্থান পোক্ত হচ্ছে। গবেষণা, উদ্ভাবন ও সমাজের ওপর প্রভাব—বিজ্ঞান গবেষণায় এ তিনটি বিষয়কে ভিত্তি ধরে শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তালিকা করে স্পেনের সিমাগো ল্যাব ও যুক্তরাষ্ট্রের স্কপাস। সিমাগো ইনস্টিটিউশনস র্যাংকিংস (এসআইআর)-এ ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে জায়গা পায় মাত্র ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। আর ২০২৩ সালে এসে সিমাগো-স্কপাসের র্যাংকিংয়ে জায়গা পাওয়াদের তালিকায় বাংলাদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮-এ।
উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি উচ্চ মাধ্যমিক, মাধ্যমিক, প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক ধাপের শিক্ষার বেশ প্রসার ঘটেছে আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরে। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশব্যাপী প্রাথমিক বিদ্যালয় অবকাঠামোর চিত্র বদলে ফেলা হয়েছে। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় শ্রেণিকক্ষ নির্মাণের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের অধ্যাধুনিক ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সম্প্রতি প্রচলিত পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল সংস্কার আনতেই নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে। এ পরিবর্তনের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে আমাদের শিক্ষার্থীরা। শত বছর ধরে আমাদের মুখস্থনির্ভর শিক্ষাপদ্ধতি চলে আসছিল। পুরনো ধারার সে পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের চিন্তার সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। নির্দিষ্ট কিছু বইয়ের নির্ধারিত অধ্যায় বা অংশ পড়ে পরীক্ষার খাতায় গৎবাঁধা কিছু নিয়েমে তা উগড়ে দেয়া হতো। নম্বরমূখী ওই ব্যবস্থায় শেখার সুযোগ ছিল অনেক কম। নতুন শিক্ষাক্রমে পুরনো সে পদ্ধতি ভেঙ্গে সম্পূর্ণ নতুন ধারার পাঠদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। কর্মমুখী শিক্ষার জোর দেয়ার অংশ হিসেবে কারিগরি শিক্ষাকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। দেশে কারিগরি শিক্ষায় অংশগ্রহণ এক সময় এক শতাংশেরো নিচে ছিল। এখন তা বেড়ে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে নেয়া হয়েছে বিশেষ বিশেষ প্রকল্প।
বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে শিক্ষার মতোই ঈর্ষণীয় সাফল্য এসেছে দেশের স্বাস্থ্য খাতেও। দেশে আগে তেমন কোনো স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ছিল না, এখন ২২টি ইনস্টিটিউট রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের বিশেষায়িত বিভিন্ন গবেষণা পরিচালিত হয়। ২০০৯ সালের আগে মাত্র আটটি মেডিকেল কলেজ ছিল, এখন ৩৭টি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য সেবা ও অবকাঠামোর মান বাড়ায় দেশের মানুষের গড় আয়ুও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালের আগে দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৬০ বছর, এখন তা ৭৩ বছর। দেশে টিকাদানে ৯৮ ভাগ সফলতা এসেছে অথচ আগে ছিল মাত্র ২০ ভাগ। আগে দেশে শিশু মৃত্যুহার ছিল ১৫০ জনের বেশি আর এখন সেটি মাত্র ২৩ জন। আগে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ৩ শতাংশ আর এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৯৮ ভাগ। আগে দেশে খর্বকায় মানুষের জন্মহার ছিল ৬০ ভাগ। কিন্তু এখন ঠিকভাবে ব্যবস্থা নেয়ায় মাত্র ২৫ ভাগের নিচে খর্বকায় মানুষ জন্ম নেয়।
স্বাস্থ্যসেবায় অবদানে মিলেছে নানা আন্তর্জতিক স্বীকৃতিও। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের জাতিসংঘের ৬৫তম সাধারণ অধিবেশনে মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল-৪-এ এ উল্লেখযাগ্য সাফল্য অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০১১ সালের জাতিসংঘের ৬৬তম সাধারণ অধিবেশনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের পক্ষে নারী ও শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নে তথ্য প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সাফল্য অর্জনের স্বীকৃতি স্বরূপ সাউথ-সাউথ পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০১৩ সালের জুন মাসে ল্যানসেট পত্রিকায় ভালো সাস্থ্য সেবা দেয়ার চমৎকার মডেলে হিসেবে বাংলাদেশকে তুলে ধরা হয়।
আর অবকাঠামো উন্নয়নে বলা চলে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত
স্বপ্নের পদ্মা সেতুসহ ছোট-বড় একশ ব্রিজ ও একশ সড়ক-মহাসড়ক চালুর মধ্য দিয়ে দেশে যোগাযোগ ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছে। উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় ঢাকাাবাসী যুক্ত হয়েছেন মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে। চট্টামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালসহ সরকার গৃহীত নানা পদক্ষেপ বদলে দিচ্ছে দেশের সার্বিক অবকাঠামো চিত্র। অবকাঠামো উন্নয়নের ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ কিছুটা সমস্যা সৃষ্টি করলেও বর্তমানে পুনরায় অগ্রগতি শুরু হয়েছে। সামনের দিনে এ অগ্রযাত্রা আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে, গড়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা ও দেশরত্নের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’।
লেখক: কোষাধ্যক্ষ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।