পঞ্জিকার পাতায় বর্ষা আসতে আরও কয়েকটি দিন বাকি। তবে এরই মাঝে টানা বৃষ্টির পরশে নতুন করে সেজে উঠেছে প্রকৃতি। বর্ষার নতুন পানিতে খাল-বিল ভরে উঠেছে। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সুগন্ধি সব ফুল। কদম, কেয়া, কামিনী, বেলি ও বকুলের সুবাসে এখন মুখরিত চারপাশ।
বর্ষায় ফোটা ফুলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- কদম, বকুল, স্পাইডার লিলি, দোলনচাঁপা, সুখদর্শন, ঘাসফুল, শাপলা, সন্ধ্যামালতি, কামিনী, গুলনার্গিস, দোপাটি ও অলকানন্দ প্রভৃতি।
বর্ষা মানেই কদম ফুল। তাই বর্ষার শুরুতেই মিলবে কদমের সৌরভ। গ্রামে গাছে গাছে ফুটে থাকা কদম ফুল বর্ষার প্রকৃতিতে এনে দেয় নজরকাড়া সৌন্দর্য। কদম গাছ দীর্ঘাকৃতির ও বহু শাখাবিশিষ্ট। কদম ফুলের আদি নিবাস ভারত, চীন ও মালয়। গ্রামাঞ্চলে নদীর তীরে, খোলা প্রান্তরে প্রচুর কদম গাছ চোখে পড়ে। শহরে দেখা মেলে পার্কে ও উদ্যানে। কদম গাছের ছোট ডালের আগায় গোল হয়ে কলি ও ফুল ফোটে।
তারপর ফুটতে শুরু করে রজনীগন্ধা, মালতিলতা, চালতা, জুঁই ও কেয়া। বর্ষার বৃষ্টিতে চিরসবুজ চালতা গাছের রূপ ফুটে ওঠে তার ফুলের সৌন্দর্যে। আকারে বেশ বড়, সাদা বর্ণের পাপড়ি ও হলদে পরাগকেশরের সমাহারে দৃষ্টিনন্দন চালতা ফুল বর্ষার প্রথমভাগে ফোটে। আগের মৌসুমে ফোটা গন্ধরাজ, রঙ্গন, রক্তজবা, টগর, শ্বেতকাঞ্চন বা ঘণ্টাফুলের উজ্জ্বলতা এখনও ম্লান হয়নি। ভরা বাদল দিনে স্বর্ণচাঁপা কিংবা দোলনচাঁপা বাতাসে ছড়ায় অনুপম সৌরভ। এমনদিনে ভেজা বাতাসে ভেসে বেড়ায় বেলি ও বকুলের সৌরভ। বকুল ফুল শুকিয়ে গেলেও এর সুবাস রয়ে যায় অনেক দিন। তাই একে সুবাসিত ফুল বলা চলে। পাঁচ বৃন্তের এ ফুলে অসংখ্য পাপড়ি থাকে।
বর্ষার ফুলের মধ্যে জুঁই ও মালতির কথা আলাদা করে বলতেই হয়।
কবি বলেছেন, শ্রাবণবেলা বাদল ঝরা/যৃথিবনের গন্ধে ভরা। ঘন সবুজ পাতার ভিড়ে থোকা থোকা ছোট জুঁই বা যূথী ফুলের সৌরভ হতে পারে বাদল দিনের পরম উপহার। বাদল বাতাস মাতে মালতির গন্ধে তাই বর্ষাযাপনে মালতিকে বাদ দিলে চলে কী করে?
বর্ষাদিনের আরেকটি ফুল ফুরুস। ইংরেজি নাম ক্র্যাব ফ্লাওয়ার। গন্ধহীন সাদা, গোলাপি বা বেগুনি রঙের ফুলটি শহরের নানা জায়গায় চোখে পড়ে। অনেকেই একে চেরি বলে ভুল করে। বর্ষা মৌসুমের ফুল দুপুরমণি বা বান্ধুলি। দুপুরবেলা ফোটে বলেই এমন নাম। গন্ধ নেই তবে অতুলনীয় রূপ মুগ্ধ হওয়ার মতোই। বর্ষার আকর্ষণীয় আরেকটি ফুল দোপাটি। গোলাপি, লাল, বেগুনি, আকাশি, নীল ও সাদাসহ কয়েক রঙের দোপাটি রয়েছে। দোপাটি একক অথবা জোড়ায় জোড়ায় ফুটতে দেখা যায়। এ সময় সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দেয় বেগুনি রঙা কলমি ফুলও।
এ ঋতুতে বৃষ্টিতে গা ধুয়ে সবুজ পাতার শাড়ি পরে দোলনচাঁপা। সন্ধ্যার সুগন্ধি সাদা ফুল ফোটায়। বড় বড় পাপড়ি দুটি প্রজাপতির ডানার মতো দেখায় বলে এর ইংরেজি নাম ‘বাটারফ্লাই লিলি’। ফুলটিকে গুলবাকাওলিও বলা হয়। ভারি ঘ্রাণ ছড়ানো এ গাছটি টবে লাগালে ঘরময় সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। সুখদর্শন বা টাইগার লিলি, বহুরঙা গ্লোরি লিলি, নানা রঙের পর্তুলিকা, ঘাসফুল, নয়নতারা, মোরগঝুঁটি, কলাবতী ও অলকানন্দারও দেখা মেলে ঘন বর্ষাতে।
বর্ষা মানে জল, জল মানেই জলজ ফুলের মেলা। তাই বর্ষা আসতে না আসতেই ফুটতে শুরু করেছে শাপলা-শালুক-পদ্মরা। বিল-পুকুর ও জলাশয়ে বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা ফুটে থাকার দৃশ্য গ্রাম-বাংলার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলে। আমাদের দেশে সাদা, গাঢ় লাল, নীল ও গোলাপি রঙের শাপলা বেশি দেখা যায়। দেশের বিভিন্ন বিলে এখন গোলাপি-পদ্মের মাতামাতি। সাধারণত গোলাপি রঙের পদ্মই বেশি দেখা গেলেও এ দেশের পুকুর ও বিল-ঝিলে সাদা রঙের পদ্মও মাঝে মধ্যে দেখা যায়। সাদা দুধের মতো এর পাপড়ির রং।
তবে দিন দিন পদ্মরা কমে যাচ্ছে। প্রকৃতির নান্দনিক আরেক সৌন্দর্য কচুরিপানা ফুল। খুব অবহেলিত হলেও এর সৌন্দর্য হƒদয় কাড়ে। গ্রামাঞ্চলে খাল, বিল, পুকুর ও জলাশয়ে প্রচুর কচুরিপানা হয় এবং গাঢ় সবুজ পাতার ওপর সাদা আর বেগুনি রঙের মিশেল ফুলগুলো দেখতে দারুণ লাগে। বর্ষার দিনে বিস্তীর্ণ জলের শান্ত চাতালজুড়ে এখন সাদা রঙের অজস্র চাঁদমালা ফুল চোখে পড়বে। ফুলগুলো খুব সাধারণ হলেও এর মুগ্ধতা অনেক অসাধারণ। -যুগান্তর