(সংকেত: ভূমিকা; বেকার সমস্যা কী; বেকারত্বের ধরণ ও প্রকারভেদ; বেকার সমস্যা ও বাংলাদেশ; বেকারত্বের কারণ; বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট; বেকারত্বের নেতিবাচক প্রভাব; বেকারত্ব দূরীকরণের উপায়; উপসংহার।)
ভূমিকা: কোনো দেশের জনশক্তির তুলনায় কর্মসংস্থানের স্বল্পতার ফলে সৃষ্ট সমস্যাই বেকার সমস্যা। বর্তমান বাংলাদেশে এই সমস্যা জটিল ও প্রকট আকার ধারণ করেছে। যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। কর্মহীন এই বিশাল উদ্বৃত্ত জনশক্তি না পারছে দেশের অর্থনীতিতে কোনো অবদান রাখতে, না পারছে নিজের সুন্দর-সমৃদ্ধ ভবিষ্যত নির্মাণ করতে। বেকারত্বের অসহ্য যন্ত্রণায় তারা জড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্র দেখা দিচ্ছে বিশৃংখলা। ক্রমবর্ধমান এই সমস্যা সমাধানে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে অর্থনৈতিক অবকাঠামো যেকোনো সময় ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়বে।
বেকার সমস্যা কী: বেকারত্ব বলতে মূলত বোঝায় কর্মক্ষম শ্রমশক্তির পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাব। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, “Unemployment (or joblessness) occurs when people are without work and actively seeking work.” The Bureau of Labour Statistics (BLS) বেকারত্বের সংজ্ঞায় বলেছে- ‘বেকারত্ব হচ্ছে এমন কিছু মানুষের কর্মহীন অবস্থা; যাদের কোনো কর্ম নেই, গত চার সপ্তাহ যাবত সক্রিয়ভাবে কাজের সন্ধান করছে এবং তারা কাজের জন্য প্রস্তুত।’ বাংলাদেশের শ্রমশক্তি সম্পর্কিত জরিপে (এলএফএস) বেকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে এমন ব্যক্তিকে যার বয়স ১০ বছর কিংবা তার বেশি; কাজের জন্য প্রস্তুত থেকে সক্রিয়ভাবে কাজের অনুসন্ধান করেও যে কাজের সুযোগ পায়নি বা কাজ করতে পারেনি।
বেকারত্বের ধরণ ও প্রকারভেদ: দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সামাজিক অবকাঠামো, বেকারত্বের সংজ্ঞা, কারণ ও বৈশিষ্ট্যের বিচারে বেকারত্ব বিভিন্ন ধরণের হতে পারে। অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাষ্ট্রীয় কাঠামোগত দুর্বলতার ফলে সৃষ্টি হয় অবকাঠামোগত বেকারত্ব। হঠাৎ কোনো মিল-কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া কিংবা স্থানান্তরের ফলে আকস্মিক বেকারত্বের সৃষ্টি হয়। কারিগরি বা প্রযুক্তিগত অপর্যাপ্ততার দরুণ বেকার সমস্যা তৈরি হয়। তৈরি পোশাকশিল্পসহ অন্যান্য মৌসুমি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেখা দেয় মৌসুমি বেকারত্ব। আবার কাজের ধরণের সঙ্গে শ্রমশক্তির দক্ষতার অসঙ্গতির ফলে সৃষ্টি হয় এক ধরণের বেকারত্ব। তবে বাংলাদেশে কাঠামোগত বেকারত্বের হারই বেশি।
বেকার সমস্যা ও বাংলাদেশ: বর্তমান বাংলাদেশে বেকার সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, কমনওয়েলথসহ একাধিক সংস্থার সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী গত এক দশকে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার বেড়েছে ১.৬ শতাংশ, যেখানে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির হার ২ শতাংশ। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে ২০২২ সালে মোট বেকারের সংখ্যা দাঁড়াবে ২১ কোটিতে। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার (আইএলও) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে মোট প্রায় ৩০ লাখ বেকার। এই বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষিত বেকারের হারই বেশি।
বেকারত্বের কারণ: বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশে বেকার সমস্যা সৃষ্টির পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানাবিধ কারণ রয়েছে। কিছু কারণ নিচে তুলে ধরা হলো-
ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব: ২০০ বছর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক এবং ২৪ বছর পাকিস্তানি শাসনের সময় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন চরমভাবে অবহেলিত হয়েছে। উপরন্তু তারা শোষণ করে নিয়ে গেছে এদেশের মূল্যবান সম্পদ। ফলে ক্রমেই ভেঙে পড়েছে অর্থনৈতিক অবকাঠামো আর বেড়েছে বেকারত্বের চাপ।
শিল্পবিপ্লবের প্রভাব: শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে অধিক উৎপাদনমুখী যন্ত্রের আবিষ্কার হয়েছে। ফলে আধুনিক কৃষিব্যবস্থা জনশক্তির পরিবর্তে কৃষিযন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। শ্রমিকের প্রয়োজন যন্ত্রে পূরণ করায় সৃষ্টি হচ্ছে বেকার সমস্যা।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর চাপ: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো চরমভাবে ভেঙে পড়ে। যুদ্ধোত্তর স্বাধীন দেশে শিল্পায়নে গতিহীনতা, সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে অদক্ষতার দরুন বিশাল একটি জনগোষ্ঠী বেকার হয়ে পড়ে। যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বাংলাদেশকে এখনও তাড়িয়ে ফিরছে।
অধিক জনসংখ্যা: বাংলাদেশে বেকার সমস্যার বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জনসংখ্যার সীমাহীন চাপই মূলত এর জন্য প্রধানত দায়ী। যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, সেই অনুপাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে না।
শিক্ষা ব্যবস্থায় অসঙ্গতি: বাংলাদেশের শিক্ষার হার কম। তদুপরি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এতে নেই বৃত্তিমূলক, কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ। বছর বছর সনদধারী শিক্ষিত জনশক্তি তৈরি হলেও তৈরি হচ্ছে না যোগ্য ও দক্ষ জনশক্তি।
অপরিকল্পিত উৎপাদন ব্যবস্থা: কৃষকের অসচেতনতা ও অপরিকল্পিত ভূমি ব্যবহার বেকার সমস্যার অন্যতম কারণ। জমির উর্বরতা হ্রাস, কোনো কোনো ক্ষেত্রে জমি উৎপাদন শক্তিহীন হয়ে যাওয়ায় নষ্ট হয় কাজের সুযোগ।
রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোগত দুর্বলতা: সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে উদ্যোগহীনতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি, সীমাহীন দুর্নীতি প্রভৃতি কারণে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। যার ফলে বাড়ছে বেকারত্বের চাপ।
কায়িক শ্রমে অনীহা: কায়িক শ্রমের প্রতি অনীহা বেকার সমস্যার একটি অন্যতম প্রধান কারণ। অভাব অনটন সত্ত্বেও এদেশের মানুষ কায়িক পরিশ্রম করতে আগ্রহী নয়। প্রাতিষ্ঠানিক চাকরি না পেয়ে বেকার হয়ে বসে থাকে, কিন্তু নিজেই আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে ভাগ্যোন্নয়নে উদ্যোগী হয় না।
বেকারত্বের নেতিবাচক প্রভাব: বেকারত্ব একটি অভিশাপ। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সর্বত্র এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বেকারত্বের ভয়াল থাবায় দুর্বল হয়ে পড়ে রাষ্ট্রকাঠামো। বেকারত্বের কারণে কোনো কাজ না পেয়ে মানুষ নানা অবৈধ ও অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়। সমাজে খুন, রাহাজানি, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। স্থবির হয়ে যায় অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা। দেখা দেয় শাসনতান্ত্রিক বিশৃংখলা। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে প্রভাবশালী দেশগুলো। ফলে দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
বেকারত্ব দূরীকরণের উপায়: বাংলাদেশের বেকারত্ব সমস্যা সমাধানের জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হবে। যথা-
– যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। অধিক জনসংখ্যাকে দেশের বোঝা নয়, সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
– বৃত্তিমূলক, কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ তৈরি করতে হবে। নারী শিক্ষার সম্প্রসারণে যথাযথ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
– ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
– কোনো কাজকেই তুচ্ছ না ভেবে কায়িক পরিশ্রমের মর্যাদা দিতে হবে।
– পরিকল্পিত শিল্পকারখানা গড়ে তুলে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
– আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ শ্রমশক্তি গড়তে তুলতে হবে।
– ভাষাগত দুর্বলতা দেশি-বিদেশি শ্রমবাজারে কর্মসংস্থ্না প্রাপ্তিতে একটি বড় সমস্যা। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শ্রমিকদের ভাষাগত দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে হবে।
– কর্মক্ষম শ্রমিকদের বিদেশে কাজের ব্যবস্থা করতে হবে।
– শিক্ষিত যুবসমাজকে গ্রামমুখী করতে হবে।
– তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ইন্টারনেটে আউটসোর্সিং হতে পারে বেকারত্ব হ্রাসের আরেকটি উপায়।
উপসংহার: বেকারত্বের ভয়াবহ অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে সমগ্র জাতিকেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলীয়করণের মনোবৃত্তি পরিহার করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্মে নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর গুণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে বেকারত্ব থেকে উত্তরণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে