আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম গুচ্ছ পরিবার দেখে বড় হয়েছেন। স্বভাবতই তাদের মধ্যে একটা নীরব অপ্রকাশিত প্রত্যাশা রয়েছে যে বৃদ্ধ বয়সে তারা ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় পার করবেন।
কিন্তু বর্তমানে পেশাগত কারণে চাকরিজীবী ছেলেমেয়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দূরে সেটেল্ড (স্থায়ী) হয় (একটা বড় অংশই বিদেশে)।
সন্তান-সন্ততি দূরে চলে যাওয়ার ফলে অনেক বাবা-মাকে একাকিত্ব বরণ করতে হয়। একাকিত্বের মাঝে বসে তারা যখন জীবনের সব হিসাব-নিকাশ-প্রত্যাশা মেলানোর চেষ্টা করেন তখন আর হিসাব মেলে না। তাদের জীবনে তখন ভর করে অবসাদ। স্বামী বা স্ত্রী হারানোদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি হয় আরও দুর্বিষহ।
গত বুধবার রাতে আবু মহসিন খানের (ঢাকাই ছবির নায়ক রিয়াজের শ্বশুর) ফেইসবুক লাইভে আত্মহত্যার খবর দেখে ভীষণ ভয় হচ্ছে। উনি যা যা বলে বলে আত্মহত্যা করেছেন তা আসলে বর্তমানে আমাদের দেশের অধিকাংশ বয়স্ক মানুষের জীবনের আত্মকথন।
‘আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়’ —এ বাক্যটা উপদেশ হিসেবে দেওয়া যতটা সহজ, যে কিনা ক্রনিক ডিপ্রেশনে ভোগেন তার জন্য তা মেনে চলা ততটাই কঠিন। প্রশ্ন হলো— ব্যক্তি হিসেবে তাদের জন্য আমরা কি করতে পারি?
প্রথমত কখনও আমাদের নিজের চিন্তাধারা দিয়ে অন্য কারও পরিস্থিতি বিবেচনা করতে চাওয়াটা উচিত না। আমরা খুব সহজেই বলে দেই, ‘আরে টেনশনের কিছু নেই, এটা কোন ব্যাপার হলো!’।
হয়তো বা আপনার কাছে এটি কোনো ব্যাপার না; কিন্তু যিনি ডিপ্রেশনে আছেন তিনি এ কথা শুনে আরও হীনমন্যতায় ভুগতে পারেন। তার সমস্যাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনুন। কারও কাছে নিজের সমস্যা প্রকাশ করতে পারাটাও আসলে অনেক বিশাল সাপোর্ট হিসেবে কাজ করে। যেহেতু আপনি প্রফেশনালি ট্রেইন্ড না, কোনো পরামর্শ দিতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
দুই. মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করছেন, তাদের দরকার কাজের পরিধি বাড়ানো। বয়স্কদের দিকেও নজর দেওয়া ও তাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। বয়স্ক নারী ও পুরুষের শারীরিক পরিবর্তন যেমন মেনোপজ বা দুরারোগ্য ব্যাধিও যে বিষণ্নতার কারণ হতে পারে মানুষকে এই ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত তরুণদের সচেতন করা।
কিছু প্রচলিত বাক্য যেমন ‘বুড়া হইছে তো তাই মাথাটাও গেছে’, ‘বয়স দিন দিন মনে হয় কমে’ থেকে বের হয়ে আসতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। এ ধরনের কথাবার্তা বয়স্কদের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করেন তাদেরকে সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
তিন. আমাদের দেশে ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা-মা অবসরে গেলে অন্য কোন কাজে যোগ না দিয়ে শুধু আরাম আয়েশ করতে উদ্বুদ্ধ করে। মানুষের জীবনে ব্যস্ততা প্রয়োজন। চাকরি জীবনে সারাদিন অফিস করে বাসায় আসলে যতটা প্রাধান্য পেতেন। রিটায়ারমেন্টের পর সারাদিন ঘরে থাকলে দেখা যায় সে পরিমাণ প্রাধান্য পাচ্ছেন না (যা খুবই স্বাভাবিক)। হুট করে এ পরিস্থিতির সঙ্গে মানাতে গিয়ে অনেকেই হীনমন্যতায় ভোগেন। ভাবেন, ‘চাকরিতে থাকতে আমাকে অনেক সম্মান ও আদর-আপ্যায়ন করা হতো, এখন আর কেউ আগের মতো ভালোবাসে না’।
চার. আপনি যদি পিতামাতার কাছ থেকে দূরে থাকেন, তা হলে চেষ্টা করুন সবসময় তাদের খোঁজখবর রাখতে। বেশি না, প্রতিদিন এক-দুই মিনিটই যথেষ্ট। যদি তাও ম্যানেজ করতে না পারেন তা হলে অন্তত সপ্তাহের ছুটির দিনে কথা বলুন। আর যদি তাও না পারেন, তা হলে আপনার আশপাশে যার বাবা-মা নেই তাদের সঙ্গে একটু কথা বলুন; তারা হয়তো তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে একবারের জন্য কথা বলতে হাজারও মাইল পাড়ি দিতে রাজি। তাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝবেন আপনি এখনও কতটা ভাগ্যবান।
পাঁচ. বয়সকালে কেউ স্বামী অথবা স্ত্রী হারালে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যিনি বেঁচে থাকেন তিনি চূড়ান্ত একাকিত্বে ভোগেন। আমাদের সমাজে বৃদ্ধবয়সে বিয়ে করাটা এক ধরনের ট্যাবু। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনার বাবা অথবা মা হওয়ার আগে তারা একেকজন মানুষ। যৌন চাহিদার চেয়ে পারস্পরিক সাহচর্যটা এ ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। সে বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিত।
ছয়. আমাদের দেশে একটা প্রবণতা আছে— বাবা-মায়েরা আমৃত্যু ছেলেমেয়েদের জন্য স্যাক্রিফাইস করে যাবেন। অনেক পিতামাতা নিজের জন্য কোনো সঞ্চয় না রেখে সব কিছু ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য খরচ করে ফেলেন, অনেকে আবার সঞ্চিত সব অর্থ ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দেন। এ দুটি বিষয়ই বয়সকালে তাদের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। একেবারে অর্থশূন্য হয়ে পড়ার কারণে অনেক সময় চিকিৎসা বা দৈনন্দিন খরচের জন্য তাদের ছেলেমেয়ের কাছে হাত পাততে হয়, যা কিনা একপর্যায়ে তাদের জন্য যন্ত্রণার কারণ হয়ে ওঠে।
সুতরাং নিজের শেষ বয়সের চিকিৎসা, প্রাত্যহিক ব্যয় ও বিনোদনের জন্য পরিমিত অর্থ হাতে রাখাই পিতামাতার জন্য বুদ্ধিমানের কাজ।
বয়স্করা সম্ভব হলে নিজেদের স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে সম্পৃক্ত করতে পারেন। অন্যের মুখে হাসি দেখতে পাওয়াটা অনেকটা নেশার মতো। হয়তোবা এখান থেকে অন্যের উপকারের পাশাপাশি সেলফ সেটিসফেকশন বা জীবনের নতুন লক্ষ্য খুঁজে পেতে পারেন। চাকরি বা সংসারের ঘানি টানতে টানতে হয়তো বা জীবনের অনেক ইচ্ছাই পূর্ণতা পায়নি, অবসর সময়ে সে অপূর্ণ শখ পূরণের চেষ্টা করতে পারেন।
লেখক: জাফর আহমেদ
স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র।
ও
সানজিদা সুলতানা রুপা
কাউন্সেলিং সাইকোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।