সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশকে প্রকৃতির লীলানিকেতন বলা যায়। অপূর্ব সৌন্দর্যে, শস্য-সম্পদে ও নানা প্রকার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ভরা এইরূপ দেশ পৃথিবীতে বিরল। ফুলে-ফলে ও সৌন্দর্যে ভরা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে মুগ্ধ হয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথলাল রায় লিখেছিলেন-
“ ধনধান্য পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা,
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
ও সে সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।“
যে জাতি হাজার বছর ধরে পরাধীনতার গ্লানি লালন-পালন ও বহন করে আসছিল , সেই জাতিকে সুসংগঠিত করে একখণ্ড স্বাধীন ভূমি উপহার দেন- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গর্বের আত্মপরিচয় হিসেবে জাতি লাভ করে, লালসবুজ পতাকা- জাতীয় সঙ্গীত-রণ সঙ্গীত। সেই মহানায়ক পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে পা রাখেন। স্বাভাবিকভাবেই দেশ শাসনের ভার জাতি তাঁর ওপর অর্পণ করে। সদ্য স্বাধীন রক্তঝরা, মুক্তিযুদ্ধে বিধ্বস্ত একটি দেশ। হাজারো সমস্যা, আর্থিক দৈন্যতা, নেই মূলধন, নেই বৈদেশিক মুদ্রা। অপরদিকে পরাজিত শক্তির উৎকট ঝামেলা, দেশ-বিদেশের গভীর ষড়যন্ত্র।
সকল প্রতিহিংসা উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২-৭৩ আর্থিক বছর প্রথম বাংলাদেশের বাজেট পেশ করেন। বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়ন খাতের মধ্যে ১০১ কোটি টাকা রাখেন কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে। সেই বাজেট কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের মাইলফলক।বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার অন্যতম ভিত্তি ছিল কৃষি।তাই তো স্বাধীনতার ঊষালগ্নে কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে তিনি দেশে সবুজ বিপ্লবের/ কৃষি বিপ্লবের ডাক দেন।শুরু হয় কৃষিতে গ্রামীণ উন্নয়ন আর আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার।মওকুফ করেন ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনার দায়।প্রত্যাহার করেন লাখ লাখ কৃষি ঋণের সার্টিফিকেট মামলা,ভূমিহীন কৃষকের নামে বিতরণ করা হয় খাসজমি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার গঠনের পরপরই কৃষিকে অগ্রাধিকারভুক্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করেন। সদ্য স্বাধীন দেশের ৩০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি পূরণে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক আমদানির মাধ্যমে এবং স্বল্প মেয়াদে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করে এবং কৃষিঋণ মওকুফ, সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার ও খাসজমি বিতরণ করে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘একটা স্বল্প সম্পদের দেশে অনবরত কৃষি উৎপাদন-হ্রাসের পরিস্থিতি অব্যাহত থাকতে পারে না। দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধির সকল প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। চাষিদের ন্যায্য ও স্থিতিশীল মূল্য প্রদানের নিশ্চয়তা দিতে হবে।’
১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়,ময়মনসিংহে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠে ঘোষিত হয়- কৃষিবিদদের আর্থ-সামাজিক মর্যাদার স্বীকৃতি -প্রথম শ্রেণির পদ মর্যাদা।সেদিন বাকৃবির আকাশে -বাতাসে ভেসে ওঠে “বঙ্গবন্ধুর অবদান,কৃষিবিদ ক্লাসওয়ান।”বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, ‘আমি তোদের পদমর্যদা দিলাম, তোরা আমার মান রাখিস’। তখন থেকে কৃষিবিদরা প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা লাভ করেন। শিক্ষার্থীদের সেদিন কাগজ কলম বইয়ের পাশাপাশি প্যান্ট- কোট খুলে গ্রামে কৃষকদের সঙ্গে কাজ করার আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি স্পষ্টভাবে সেদিন বলেছিলেন সবুজ বিপ্লব ব্যতিত দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসস্পূর্ণতা অর্জন করেছে। তার শুরুটা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং তার অসমাপ্ত কাজটুকু সম্পন্ন করেছেন তারই সুযোগ্য উত্তরসূরী কৃষকরত্ন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণই নয়, বরং আজ কৃষি পন্য বহিবিশ্বে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। আজ কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথ ধরে তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন দীর্ঘ ২১ বছর পর সরকার গঠন করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার কর্মসূচি হিসেবে চিহ্নিত করেন। তখন দেশে খাদ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৪০ লাখ মেট্রিক টন। বাজেটে কৃষি গবেষণার জন্য একটি পয়সাও কোনো বরাদ্দ ছিল না। সে বছর ১২ কোটি টাকা শুধু কৃষি গবেষণার জন্য বরাদ্দ করা হয় এবং পরবর্তী বাজেটে ১০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ পায় কৃষি এবং আইসিটি এই দুই সেক্টর। শুরু থেকেই কৃষি গবেষণাকে সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। ফলে পরবর্তী পাঁচ বছরে উন্নয়ন-অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে অর্জিত হয় চমকপ্রদ সাফল্য। প্রথমবারের মতো দেশ খাদ্যে নির্ভরশীলতা অর্জন করে।
২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বিএনপি-জামাত জোট সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আবারো দেশের কৃষিতে স্থবিরতা নেমে আসে। ২০০২ সালে দানাজাতীয় খাদ্যের উৎপাদন ২ কোটি ৬৮ লাখ টন থেকে নেমে আসে ২ কোটি ৬১ লাখ টনে। আবারো শুরু হয় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারা।২০০৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বে যখন দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে তখন খাদ্য ঘাটতি ছিল ২৬ লাখ মেট্রিক টন। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিন বদলের সনদ’ অনুযায়ী ‘রূপকল্প ২০২১’ প্রণয়ন করা হয়। পাশাপাশি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয় কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে।
আওয়ামীলীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি প্রদান, ১০ টাকায় কৃষকের জন্য ব্যাংক হিসাব চালুকরণ, সেচ সুবিধা বৃদ্ধি, কৃষিতে প্রণোদনা প্রদান, সার বিতরণ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ফলশ্রুতিতে ২০১৩ সালে এসে দেশ শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাই অর্জন করেনি, খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হয়। এসডিজি কে সামনে রেখে ২০০৯ সালে উন্নয়নের যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল তার গতি ও পরিধি সরকারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়াদে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়।
দ্বিতীয় মেয়াদে প্রণীত হয় (২০১৪-১৮) সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। এরই অংশ হিসেবে রূপকল্প ২০২১ এবং রূপকল্প ২০৪১ এর আলোকে জাতীয় কৃষিনীতি, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, ডেল্টাপ্লান ২১০০সহ নানা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার। দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যমোচন ও রপ্তানি আয়ে মৎস্য খাতের অবদান আজ সর্বজনস্বীকৃত। জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদন করেছে ৪৭ দশমিক ৫৯ লাখ টন। এ সময় ৭৪ হাজার ৪২ টন মৎস্য পণ্য রপ্তানি করে ৫ হাজার ১৯১ কোটি টাকা সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বর্তমান প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৪১ সালে দেশে মাছের উৎপাদন দাঁড়াবে ৯০ লাখ টন।
বাংলাদেশ হতে নানাবিধ কৃষিপণ্যসমূহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এরমধ্যে পাট ও পাটজাত দ্রব্য, চা পাতা, আম, কাঁঠাল, লেবু, লিচু, লটকন, আমড়া, পেয়ারা, শুকনা বরই, হিমায়িত সবজি আলু, কচু, পটল, মুখীকচু, লাউ, পেঁপে, শিম, করলা, কাকরুল, চিচিঙ্গা, মিষ্টি কুমড়া, গুড়া মসলা, কালিজিরা, হলুদেপরীক্ষাগারের অভাব, বিমানবন্দরে হিমাগারের পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকা, বিভিন্ন কৃষিপণ্যের কাক্সিক্ষত জাতের অভাব, ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট প্রাপ্তি সহজীকরণ ইত্যাদি। গুণগত মানসম্পন্ন ও নিরাপদ সবজি ফল উৎপাদন, শ্যামপুরস্থ প্যাক হাউজের কার্যকর ব্যবহার, বিমানে কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে স্পেস বৃদ্ধি, কৃষিপণ্যর জন্য বিমান বন্দরে পৃথক গেট ও স্ক্যানার মেশিন স্থাপন করা, বিমানবন্দরে ইঅউঈ-এর ক্লোড বেটারেজের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ, বিমান ভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে আনা, কৃষিপণ্য পরিবহনের সুবিধা বৃদ্ধি, পণ্য রপ্তানির জন্য প্যাকেজিং এর মান বৃদ্ধি, আলুর উন্নত জাতের সরবরাহ বৃদ্ধি, বিদেশস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তা বৃদ্ধি, দেশে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পরীক্ষাগার তৈরি ইত্যাদি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি এদেশের কৃষিপণ্য রপ্তানীতে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করতে পারে।
লেখক- সহকারী অধ্যাপক,ফিশারিজ বিভাগ ও প্রভোস্ট (ভারপ্রাপ্ত),মির্জা আজম হল, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়