গৌরব গাঁথা মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বর্ণ উজ্বল ইতিহাস আমাদের অহংকার। দেশের এই স্বাধীনতা অর্জনে যারা জীবন বাজী রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন আজো যাচাই-বাছাই নামক হয়রানীর আর্বতে ঘুরপাক খাচ্ছে। বার বার এই অসম্মান জনক প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হচ্ছে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে।
রাজনৈতিক কারনে দেশে অসংখ্যবার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পূনঃ পূনঃ যাচাই-বাছাইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। জানা যায়, ১৯৮৭- সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কোন কোন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রায় ৭-৮ বার যাচাই-বাছাইয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
১৯৮৭-৯৪ সালে ২ বার তালিকা প্রণয়নের সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রথম তথ্য প্রমানাদি দিতে প্রধানমন্ত্রীর দিক নির্দেশনায় বৃহৎ কর্মসূচীর আওতায় ব্যাপক যাচাই-বাছাই ও মুক্তিযোদ্ধা তালিকা করা শুরু হয়।
দীর্ঘদিন ধরে পর্যায়ে-পর্যায়ে এবং স্তরে- স্তরে এ যাচাই-বাছাই কার্যক্রম চলে। প্রথম পর্যায়ে কারো সর্ম্পকে নূন্যতম অভিযোগ জানালে পরবর্তী পর্যায়ে পূনরায় তার যাচাই-বাছাই হয়েছে। কয়েক পর্যায়ে যাচাই-বাছাই শেষে উপজেলা ভিত্তিক খচড়া তালিকা প্রণীত হয়েছে। খসড়া তালিকার উপর চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই শেষে তালিকাটি মুক্তিবার্তা পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে।
তালিকা প্রকাশের পরে কারো সর্ম্পকে কোন অভিযোগ আনিত হলে তা পূনঃ যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে। অতঃপর চূড়ান্ত তালিকাটি প্রকাশিত হয়েছে লাল মুক্তিবার্তা নামে, যা ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা পেয়ে সমাদৃত হয়েছে, এবং চলমান আছে।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, এছাড়াও লাল বই-তে অর্ন্তভূক্ত থাকা মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৯৮-২০০০ সালে যখন কল্যান ট্রাস্টের ভাতার জন্যে আবেদন করেছিলেন, তখন নীতিমালা অনুযায়ী স্ব-স্ব জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তাদেরকে পৃথক তদন্ত এবং যাচাই-বাছাইয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়েছিল। এখানেই শেষ নয় সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে একই মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পূনরায় যাচাই-বাছাইয়ের মুখোমুখি করা হয়। ২০০২ সালে সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জাতীয় পর্যায়ে গঠিত “যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি” আবারো যাচাই-বাছাই করেন।।
একজন সাবেক কমান্ডার জানালেন, লাল মুক্তিবার্তাভূক্ত এসকল মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা সরকারী চাকুরী করেছেন, তাদেরকে পৃথকভাবে আরো দুইবার যাচাই-বাছাই হতে হয়েছে। প্রথমতঃ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চাকুরীতে প্রবেশকালীন, দ্বিতীয়তঃ মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে চাকুরীর সময়কাল ১ বছর বৃদ্ধিকালীন।
এছাড়া ২০০৫ সালে যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তালিকায় (গেজেট) অর্ন্তভূক্ত হয়েছে, তাদেরকেও যথাযথ প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই হয়েই তালিকাভূক্ত হতে হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটি উপযুক্ত তথ্য- প্রমানাদি পর্যবেক্ষণ এবং যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করেছেন। এতো কিছুর পরেও থেমে থাকেনি মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই।
২০১৬-১৭ সালে অনলাইনে নতুন আবেদনকারীদের পাশাপাশি পূর্ব তালিকাভূক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই যাচাই-বাছাইয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। দিতে হয়েছিল নিজের স্বপক্ষে যথাযথ প্রমানাদি।
এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধারা জানান, নতুন আবেদনকারীদের যাচাই-বাছাই হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে তথাকথিত অভিযোগের দোহাই দিয়ে সেই সকল মুক্তিযোদ্ধাদেরকে কেন? যারা ইতিপূর্বে বহুবার বহুভাবে পূনঃ পূনঃ যাচাই-বাছাই শেষে দীর্ঘকাল যাবৎ একাধিক তালিকাভূক্ত আছেন।
সচেতন মুক্তিযোদ্ধা মহল আরো জানান, বহুদিন ধরেই কিছু প্রতিহিংসা পরায়ন মানুষ সুযোগ পেলেই কারো না কারো সর্ম্পকে মনগড়া অভিযোগ দিয়ে আসছে। আর এই প্রবণতা দেশের মধ্যে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলায় সব চেয়ে বেশী বলে জানা যায়। রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও ব্যাক্তিগত রেষারেষি, দলাদলি, শক্রতা এবং প্রতিহিংসা বশতঃ এসব অভিযোগ হয়ে আসছে। মনগড়া এসকল অভিযোগের স্বপক্ষে থাকে না কোন তথ্য -প্রমান কিংবা ব্যাখ্যা।
নীতিমালা মোতাবেক এসব অভিযোগের গ্রহনযোগ্যতা না থাকা স্বত্বেও একেক সময় একেক ধরনের প্রভাবশালীর প্রভাবে কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়ে পড়ে। তবে মুক্তিযোদ্ধারা দাবী করেন কর্তৃপক্ষগণ যদি ভিত্তিহীন ও তথাকথিত এসব অভিযোগকে আমলে নেওয়া বন্ধ না করেন, তবে মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ভূলুন্ঠিত হতেই থাকবে এবং যুগ যুগ ধরে চলতেই থাকবে যাচাই-বাছাই। বির্তকিত থেকে আরো বির্তকিত হয়ে উঠবে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম।
লেখকঃ মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক