বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আতঙ্কের রোগ হচ্ছে হার্টঅ্যাটাক। সুস্থ-সবল মানুষ মুহূর্তেই বুকের ব্যথায় কাতর হয়ে পড়ে। বিশ্বজুড়ে মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণও হৃদরোগ।
প্রতি বছর বিশ্বে যে পরিমাণ লোক মারা যায়, তার ৩১ শতাংশ মারা যাচ্ছে হৃদরোগে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন যে হারে হৃদরোগ হচ্ছে, আগামী ২০৩০ সালে বিশ্বজুড়ে ২৩ মিলিয়ন লোক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে। হৃদরোগের বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো।
অনেক সময় পূর্বলক্ষণ ছাড়াও অনেকে হার্টঅ্যাটাক করেন। আবার অনেকের হার্টে ব্লক ধরা পড়ার পর হার্টঅ্যাটাক হয়।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এসএম মোস্তফা জামান।
ভৌগোলিক কারণে অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ, ভারতসহ এ অঞ্চলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি। কারণ আমাদের দেশের মানুষ অল্প বয়সে ধূমপান করা শুরু করে, চর্বিযুক্ত খাবার বেশি খায়। কোন খাবার স্বাস্থ্যকর আর কোনটা অস্বাস্থ্যকর, সে বিষয়ে আমাদের দেশের মানুষের ধারণা কম।
ভৌগোলিক কারণে এ দেশের মানুষের উচ্চতা কম। ফলে তাদের হার্টের করোনারি আর্টারি (ধমনি) সরু থাকে, যা সাধারণত অল্পতেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়।
ব্লক ছাড়াও কি হার্টঅ্যাটাক হয়
একটা গ্রুপের রোগী আমরা পাই, যারা অল্প বয়স থেকে মাদকদব্য গ্রহণ করছে, তাদের কোনো রিস্ক ফ্যাক্টর নেই। তার পরও দেখা গেছে, তাদের বুকে ব্যথা আছে। তাদের হার্টঅ্যাটাক হয়েছে। এনজিওগ্রাম করে তাদের হার্ট নরমাল পাওয়া যাচ্ছে। তাদের আসলে এক ধরনের করোনারি স্পাজম হয়ে হার্টঅ্যাটাক হচ্ছে। হার্টঅ্যাটাক হয়েছে অথচ এনজিওগ্রাম করে করোনারি ধমনিতে ব্লক পাওয়া যাচ্ছে না।
কেন ব্লক ছাড়া হার্টঅ্যাটাক হচ্ছে, তা এখন চিন্তার বিষয়। এটি আমরা বলে থাকি— মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন নো অবস্ট্রাকটিভ করোনারি অ্যাথেরোসেক্লেরোসিস (মিনোকা)। এ বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম চালানোর জন্য আমরা সরকারের কাছে আবেদন রাখছি।
রিস্ক ফ্যাক্টর কি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব
হৃদরোগের কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর আছে। এসবের কিছু আমাদের ছন্দগত জীবনযাপনের মাধ্যমে কমানো যায়। কিন্তু যদি কারও পরিবারে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ও শিশুর জন্মগত হৃদরোগ থাকে, তবে সে ক্ষেত্রে ঝুঁকি কমানোর জন্য আমাদের কিছুই করার থাকে না।
হৃদরোগ প্রতিরোধে করণীয়
হার্ট পাওয়ারফুল করতে হলে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। যেমন— স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণের পাশাপাশি ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশুদের জাঙ্ক ফুড খাওয়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। হৃদরোগ প্রতিরোধে কায়িক পরিশ্রম করা, হাঁটাহাঁটি করা, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, ধূমপান না করা ও খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
চিকিৎসা
হার্টঅ্যাটাক একটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা, যেখানে জীবন ও মৃত্যু খুব কাছাকাছি চলে আসে। কোনো ব্যক্তির হার্টঅ্যাটাক হলে সে অল্পতেই ভালো হতে পারে। আবার হতে পারে প্রাণঘাতী। তাই হার্টঅ্যাটাকের চিকিৎসাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। চিকিৎসক ও রোগীর পরিবারকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে রোগী যাতে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পায়। সাধারণত ইকো-ইসিজি করে নিশ্চিত হওয়া যায়, রোগীর হার্টঅ্যাটাক হয়েছে কিনা। হার্টঅ্যাটাকের চিকিৎসার প্রথম ধাপ হলো— এসপিরিন গ্রুপের ওষুধ ও ইনজেকশন দিয়ে রক্ত পাতলা করা।
এর পর প্রাথমিক এনজিওপ্লাস্টি করে জমাট বাঁধা রক্ত অপসারণ করা। এর পরও অনেক সময় রোগী ঝুঁকিমুক্ত হয় না। যদি রোগীর অনিয়মিত হৃদস্পন্দন হয়, সে ক্ষেত্রে রোগীর ঝুঁকি থেকে যায়। এ অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের সমস্যা মোটেও অবহেলা করা যাবে না।
কেননা অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের ফলে আবারও হার্টঅ্যাটাক হতে পারে। তাই হার্টঅ্যাটাকের প্রথম ৪৮-৭২ ঘণ্টা অবিরাম ইসিজি মনিটরিং করে দেখতে হবে, অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের সমস্যা আছে কিনা।
একই সঙ্গে রোগীর রক্তচাপ ঠিক আছে কিনা, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। বেড সাইড ইকো করে সর্বদা হৃদযন্ত্রের পর্দার অবস্থার ওপর নজর রাখতে হবে। স্টেথোস্কোপ দিয়ে দেখতে হবে হৃদযন্ত্র থেকে কোনো অস্বাভাবিক শব্দ হচ্ছে কিনা।
কারণ রোগীর হার্টের ভেতর বা বাইরের পর্দা ফেটে গেলে তা সবচেয়ে মারাত্মক অবস্থা বলে গণ্য করা হয়। এ অবস্থায় রোগীকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সার্জারি না করলে মৃত্যুর ঝুঁকি ৯৯ শতাংশ বেড়ে যায়।
সর্বোপরি হার্টঅ্যাটাকের পর ২-৩ দিন রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা প্রয়োজন। অবস্থা স্থিতিশীল হলে চিকিৎসকের দায়িত্ব, রোগীকে কাউন্সেলিং করে খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রা ও পরবর্তী চিকিৎসা, যেমন— এনজিওগ্রাম কখন করাবে ইত্যাদি সম্পর্কে অবহিত করা।