ভ্যাকসিন কুটনীতি আর রাজনীতিতে বাংলাদেশ কী শক্তিমান দেশগুলোর গিনিপিগ হতে যাচ্ছে? বাইরে বাইরে তারা শত্রুতা দেখালেও বাণিজ্যে কোনো শত্রুতা নেই,এটা কী আবারো প্রমাণিত হতে যাচ্ছে?
চীনের ভ্যাকসিন যাতে বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে সে জন্য ভারত,ব্রিটেন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ব্রিটেনের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোম্পানীর ভ্যাকসিন উৎপাদন হচ্ছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে। ফিফটি ফিফটি শেয়ার তাদের। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। এই ভ্যাকসিনের একটা বড় বাজার হবে বাংলাদেশ। ১৭ কোটি মানুষের বাজার। এ বাজার ধরার জন্য সবার মাথা নষ্ট হওয়ার যোগাড়।
বাংলাদেশে বড় ওষুধ উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ী হলো বেক্সিমকো। বেক্সিমকোর মালিক সালমান এফ রহমান চীন ও পাকিস্তান লবি মেনটেইন করেন এটাই রাজনীতিতে প্রচার আছে। কয়েকদিন আগে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে এখানকার দূতাবাসের অনুষ্ঠানের স্পনসর করেছে বেক্সিমকো। পাকিস্তান দূতাবাসের অনুষ্ঠান স্পনসর করে বেক্সিমকো আর খবর ছাপানো ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের নিউনেশন পত্রিকা। এ নিয়ে সাংবাদিক আর সিভিল সোসাইটির আড্ডায় নানা গল্প শোনা যায়।
সঙ্গত কারণেই বেক্সিমকো যেহেতু চীন ও পাকিস্তান লবির ফলে চীনের ভ্যাকসিন বাজারজাত করার দায়িত্ব পাওয়ার কথা বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের। তারাও আশা করেছিল চীনের এ কাজটা তারা পাবে।
কিন্তু চীন আশাভঙ্গ করে। চীন এখন জাত ব্যবসায়ী। ভ্যাকসিনের নগদ আর মনোপলি ব্যবসা তারা কাউকে দেবে না।
বাজারে খবর আছে চীনা কোম্পানি সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন বাজারজাত করার জন্য বেক্সিমকো সবধরণের চেষ্টা চালিয়েছে। শুরুতে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন যাতে বাংলাদেশে পরীক্ষা না হয়, ঢুকতে না পারে এ জন্য সরকারের “পাওয়ার ম্যান”দের উপর খবরদারি করেছে বেক্সিমকো। চীনের ভ্যাকসিন ট্রায়ালের সুযোগ পেতেও চাপ ছিল তাদের। বেক্সিমকোকে বাজারজাতের স্বত্ব দেয়া নিয়ে চীন ছিল নীরব। ফলে বেক্সিমকো ধরে নিয়েছিল তারা চীনা ভ্যাকসিনের স্বত্ব পাবে।
গত দু মাস ধরে চীনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল নিয়ে বাংলাদেশ শাঁখের করাতের মধ্যে পড়ে।
একদিকে আমাদের নতুন বন্ধু চীন আরেকদিকে পুরনো বন্ধু ভারত ও ব্রিটেন। চীনকে হ্যাঁ বললে ভারত অখুশি আর ভারতকে হ্যাঁ চীন অখুশি। এ নিয়ে গত দুমাস ধরে চলে ইঁদুর বিড়াল লড়াই। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব মি. হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা এ নিয়ে ঢাকা পর্যন্ত চলে আসেন। ভারতে উৎপাদিত অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন নিয়ে আশার বানী শুনিয়ে যান।
কিন্তু এ আশায় গুড়ে বালি দিয়ে বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক জানান, সরকার চীনের ভ্যাকসিন পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছে। এ নিয়ে নড়েচড়ে বসে ভারত আর ব্রিটেন। অন্যদিকে সর্বোচ্চ চাপাচাপি করে বেক্সিমকোও নিশ্চিত হয়েছে চীনা কোম্পানি তাদেরকে বাজারজাতের স্বত্ব দেবে না। তারা নিজেরাই বাজারজাত করবে আর এ দেশের অন্য কোম্পানিও ঢুকে গেছে বেক্সিমকোকে বাইপাস করে । হিসেব নিকেশ করে চায়না তাদের লাভ লোকসান দেখেছে।
ফলে আশাহত হয়ে বেক্সিমকো পুরো ইউটার্ন নিয়ে সোজা ভারতের উঠোনে ঢুকে পড়েছে। সেরামের দ্বারস্থ হয়েছে। শুক্রবারই বেক্সিমকোর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন বাংলাদেশে তারা বাজারজাত করবে। এ জন্য চুক্তিও স্বাক্ষর হয়োছে। অর্থাৎ বেক্সিমকো এখন ভারতের সেরামের পক্ষ হয়ে নামবে। ফলে চীনের ভ্যাকসিন এখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। তারা আদৌ আর ট্রায়াল করতে পারবে কি না তা সময়ই বলে দেবে। কারণ এই ট্রায়ালও অনেক জটিল প্রক্রিয়া।
তাই বলা যায় বাণিজ্য আর রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু মিত্র বলতে কেউ নেই। বেক্সিমকো যেখানে চীনের স্বার্থ দেখার কথা সেখানে ভ্যাকসিনের কারণে এখন ভারতের স্বার্থ তাদের দেখতে হবে।
বাংলাদেশের উচিত হবে ভালো ভ্যকসিন পাওয়ার নিশ্চয়তা চাওয়া। গুনগত মান আর মানুষের আর্থিক সামর্থ্য দুটাই বিবেচনা করতে হবে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা আর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ল্যাবে ( সেরাম ইনস্টিটিউট) উৎপাদিত ভ্যাকসিন কার্যকর বেশী হবে এটাই মনে করেন ওষুধবিজ্ঞানীরা। আমি মনে করি করোনাভাইরাস উৎপাদনকারী দেশ চীনের উৎপাদিত ভ্যাকসিন কার্যকর কেমন হবে তা অবশ্যই যাচাই-বাছাই করতে হবে।
খবর আরও আছে। রাশিয়ার পুতিন ইতিমধ্যে বলেছেন তাদের ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও বলেছেন বছর শেষে তাদের ভ্যাকসিনও চলে আসবে।
তবে বাংলাদেশের বাজার নিয়ে রাশিয়া আমেরিকার মাথাব্যথা দেখছি না। এই বাজার দখল করার যুদ্ধে নেমেছে চীন আর ভারত।
আমাদের জন্য কোনটা উপযোগী হবে সেটা আমাদেরই বিবেচনা করতে হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতি। বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন, পক্ষপাতমুক্ত হয়ে দেশ ও জনগণের জন্য যেটা ভালো হয় সেটা বিবেচনা করলেই দেশের জন্য মঙ্গল।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক