যেকোনো রাষ্ট্রের শক্তি জানান দেয় পারমাণবিক সক্ষমতার উপর। পারমাণবিক অস্ত্র পৃথিবীর অনেক দেশেই মজুত আছে। সেটি বরং সংঘাতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্র মজুতের শীর্ষে আছে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়াও, চীন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, পাকিস্তান, ভারত, ইসরায়েল ও উত্তর কোরিয়াসহ ৯ দেশের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় পারমাণবিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তান। দুটো দেশের রাজনৈতিক টানাপড়েনের কারণে পারমাণবিক শক্তির মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চলে আসছে বহুদিন ধরে। বাংলাদেশ এদিক থেকে ব্যতিক্রম ভুমিকা পালন করছে। কারো সঙ্গে বৈরিতার পথে না গিয়ে নিজ দেশের মানুষকে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে বিশ্বের ৩৩তম পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে। এরইমধ্যে তা কড়া নিরাপত্তার মধ্য নিয়ে রূপপুরে পৌঁছাছে। আগামী ৫ অক্টোবর রূপপুরে ইউরেনিয়াম আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তরে এক অনুষ্ঠান হওয়ার কথা রয়েছে। এটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তাঁরা দুজন অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হতে পারেন।
ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, ইউক্রেন, জার্মানি, জাপান, স্পেন, সুইডেন, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ভারত, চেক প্রজাতন্ত্র, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, বুলগেরিয়া, পাকিস্তান, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, রোমানিয়া, আর্জেন্টিনা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বেলারুশ, স্লোভেনিয়া, নেদারল্যান্ডস, ইরান ও আর্মেনিয়া।
পাবনার ঈশ্বরদীতে নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেই প্রকল্পটি দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হওয়ার আগেই আশপাশের এলাকার মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেছে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাজ করেন প্রায় পাঁচ হাজার বিদেশি কর্মী। তাদের বেশিরভাগই রুশ নাগরিক। তাদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে রূপপুরে এসেছে পরিবর্তন। আগে যেখানে সন্ধ্যা হলেই গাঢ় অন্ধকার নেমে আসতো এখন সেখানে গভীর রাতেও ঝলমল করে নানা রঙের আলো।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরুর পর গত কয়েক বছরে সেখানে গড়ে উঠেছে নানা অবকাঠামো। পাশাপাশি রুশভাষাভাষী কয়েক হাজার বিদেশি কর্মীদের অবস্থানে সেখানকার অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় প্রভাব পড়েছে রাশিয়ার ভাষা ও সংস্কৃতির। সেখানে প্রায় প্রতিটি দোকানেই রাশিয়ার ভাষা সম্বলিত সাইনবোর্ড দেখা যায়। স্থানীয়রা বিদেশি নাগরিকের দৈনন্দিন পণ্য বিক্রি করে হচ্ছেন স্বাবলম্বী।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে রাশিয়ার সেরা কর্মকৌশল চর্চা, বহু বছরের অভিজ্ঞতা এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাকে কাজে লাগানো হয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ ইউনিটের অ্যাকটিভ ও প্যাসিভ ব্যবস্থার অনন্য সংমিশ্রণ কেন্দ্রের নিরাপদ পরিচালনা নিশ্চিত করবে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পিত মাত্রার নিশ্চয়তা দেবে। আশা করা যায়, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেবল বাংলাদেশে জ্বালানি সরবরাহের সমস্যার সমাধানই করবে না, দেশবাসীর সার্বিক জীবনমানের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
নির্মাণ কাজ শেষ হলে রূপপুর কেন্দ্রের দুটি ইউনিটে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা রয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীর ৩০টি দেশে ৪৫০টির মতো পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। সেগুলো থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতের পরিমাণ মোট উৎপন্ন বিদ্যুতের প্রায় ১২ শতাংশ। এসব বিষয় বিবেচনা করে বর্তমান সরকার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপের অংশ হিসেবে দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ থেকে উৎপাদনের মহাপরিকল্পনা নিয়েছে। এটা নিশ্চিতভাবে বর্তমান সরকারের উত্তম প্রয়াসগুলোর অন্যতম একটি এবং জাতি হিসেবে বিশ্বে গর্ব করার মতো একটি প্রকল্প।
যেকোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিদ্যুতের ব্যবহার অপরিহার্য। উন্নয়ন অব্যহত রাখতে হলে প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিদ্যুতের সরবরাহ। ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময়ে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাটের ফলাফল হিসেবে এদেশের বিদ্যুৎখাত পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে দেশকে সে অবস্থা থেকে তুলে এনে আজকে শতভাগ বিদ্যুতায়নের দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু ধারাবাহিক উন্নয়ন, শিল্পায়ন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিশ্চয়তায় আরও বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রয়োজন। তার জন্য পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের বিকল্প আর কিছু হতে পারে না। জলবায়ু পরিবর্তনের কথা চিন্তা করে বর্তমানে বিশ্বে টেকসই শক্তি উৎপাদনে যেসব উৎসের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে পারমাণবিক শক্তি তার অন্যতম একটি উৎস।
আশা করা হচ্ছে, অর্থনীতিতে একটি শক্ত ভীত গড়বে এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। একে ঘিরে তৈরি হবে আরও নতুন নতুন কর্মসংস্থান, সম্ভাবনা। পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশ হওয়ার সাথে সাথে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ বোর্ডের সদস্য হল বাংলাদেশ, যা দেশের ইতিহাসে নতুন একটি মাইলফলক। জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ বোর্ড পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ উপায়ে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আন্তঃসরকারি ফোরাম হিসেবে কাজ করে। সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে নানা সুবিধা প্রাপ্ত হবে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।