আমার ২০১০ সালে মিশরের পিরামিড দেখার সুযোগ হয়েছিল। আমি সে সময় জাপানি একটি কোম্পানি কে লাইনের একটি জাহাজে যোগদানের জন্য মিশরে গিয়েছিলাম। আমার জয়নিং স্থান ছিল পোর্ট সাঈদ যা কায়রো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
আমার সে সময় জাহাজে যোগদানের পূর্বে রাজধানী কায়রোতে গিজার পিরামিড দেখার সুযোগ হয়েছিল। কায়রো এয়ারপোর্ট থেকে পিরামিড দেখার জন্য গিজাতে যাই। গিজাতে দেখলাম প্রচুর বিদেশি দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। তারপরও অল্প সময়ের মধ্যে যতটুকু সম্ভব ঘুরে দেখার চেষ্টা করলাম। পিরামিড দেখা হয়ে গেলে আবার পোর্ট সাঈদের উদ্দেশ্যে রওনা হই এবং সেখানে যেয়ে জাহাজে যোগদান করি। আমি সেই সময় জাহাজে সেকেন্ড অফিসার হিসাবে কর্মরত ছিলাম।
পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় স্থানগুলোর একটি হলো গিজার পিরামিড। এর নির্মাণ কৌশল নিয়ে আজও নানা রকম প্রশ্ন রয়েছে ইতিহাসবিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ, এবং বিজ্ঞানীদের মনে। বিভিন্ন রকম গবেষণাতেও এসব রহস্যের সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে গিজায় পিরামিড তৈরি হয়েছিল। সে সময় মিশরের মানুষের বিশ্বাস ছিল মৃত্যুর পরের জীবনই হল অনন্ত জীবন। তাই মৃত্যুর পর দেহ অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষণ করার জন্য এবং পরলোকে অনন্ত শান্তির জীবন পেতে মিশরের সম্রাটদের জন্য চুনাপাথর খন্ড দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল পিরামিড।
মিশরের সবচেয়ে বড়, পুরনো এবং আকর্ষণীয় পিরামিড হচ্ছে গিজার পিরামিড। গিজার মহাপিরামিড বা খুফুর পিরামিডকে ইংরেজিতে গ্রেট পিরামিড অফ গিজা বলা হয়। গিজার গোরস্থানে তিনটি পিরামিড রয়েছে। এর মধ্যে খুফুর পিরামিড টি সবচাইতে পুরাতন এবং বড়। এটির অবস্থান মিশরের এল গিজা নামক স্থানে। এটি তৈরি হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বে। এর উচ্চতা ৪৬০ ফুট। জানা যায় এটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় ২০ বছর এবং শ্রমিক কাজ করেছিল আনুমানিক এক লক্ষ। পিরামিড টি তৈরি করা হয়েছিল বিশাল বিশাল পাথর খন্ড দিয়ে।
পিরামিড তৈরিতে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল পাঁচ হাজার বছর পূর্বে যা কল্পনা করা আশ্চর্য ব্যাপার। অনেক বিজ্ঞানী এটাকে মানুষের তৈরি বলে মনে করেন না। তারা বলেন পিরামিড ভিনগ্রহের প্রাণী বা এলিয়েনের তৈরি। অনেকে আবার মনে করেন বর্তমান যুগের থেকেও তৎকালীন মিশরীয়রা প্রযুক্তিতে এগিয়েছিল।
জানা যায় মিশরীয়রা পাথরের তৈরি হাতুড়ি এবং তামার সাহায্যে পিরামিড তৈরি করেছিল। বড় বড় পাথর দিয়ে মিশরীয়রা তৈরি করেছিল পিরামিড। এই পাথরখণ্ডের বেশকিছুর ওজন ৬০ থেকে ৭০ টনের মত। ধারণা করা হয় নীল নদের পানিতে ভাসিয়ে আনা হতো এই বিশাল আকৃতির পাথরগুলো।
যে পাথর দিয়ে পিরামিড তৈরি করা হয়েছে সেটি কোন সাধারণ পাথর নয়। পিরামিড নির্মাণে ব্যবহৃত পাথরগুলো যেকোনো চুনা পাথরের চেয়ে শতগুণ শক্তিশালী। পৃথিবীতে এই ধরনের অনেক পাথর আবিষ্কৃত হয়েছে কিন্তু পিরামিডে ব্যবহৃত পাথর পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই পিরামিডে ব্যবহৃত পাথর নিয়েও রয়েছে রহস্য।
রাতে পিরামিডের দিকে তাকালে দেখা যায় গিজার তিনটি পিরামিডের অবস্থান আকাশের তিনটি তারার সাথে মিলে যায়। তারা তিনটিকে একত্রে বেল্ট অফ ওরিয়ন বলা হয়। ভূমি থেকে দেখা হলে তিনটি পিরামিড এর উপরে একটি নিখুঁত সরলরেখায় তারা তিনটিকে দেখা যায়। তারার সাথে অবস্থানের মিল রেখে এমন নিখুঁত আকার কিভাবে তৈরি করা হয়েছে সেটি এখনো অজানাই রয়ে গেছে।
গিজার পিরামিড একেবারে পৃথিবীর মাঝখানে অবস্থান করছে। পিরামিডের নিখুঁত নির্মাণ দেখে অনেক বিজ্ঞানীদের মতে লেজার টেকনোলজি ছাড়া এটি নির্মাণ করা অসম্ভব।
পিরামিড মরুভূমিতে অবস্থিত। বাইরে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড থেকে ৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এর মধ্যে থাকে। কিন্তু পিরামিডের ভেতরে তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড এর মতো থাকে। হাজার বছর ধরে এই তাপমাত্রা ধরে রেখেছে পিরামিডগুলি। দেখা গেছে পিরামিডের ভিতরে এক ধরনের প্রাকৃতিক বায়ুর ব্যবস্থা রয়েছে।
মিশরে নির্মিত পিরামিডের আরেকটি রহস্য হচ্ছে এর ভিতর নির্মিত টানেল বা সুড়ঙ্গ পথ। এসব পিরামিডের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য সুড়ঙ্গ পথ। কেন এই সুড়ঙ্গ পথগুলো তৈরি করা হয়েছিল তার সঠিক উত্তর এখনো কেউ দিতে পারেনি।
গিজার পিরামিডের সামনে রয়েছে বিখ্যাত স্ফীংস মূর্তি।এটির মাথা মানুষের মত আর বাকি অংশ সিংহের মতো। এটি মিশরের সবচেয়ে প্রাচীন ভাস্কর্য বলে জানা যায়। এটি ২০ মিটার উঁচু এবং ৭৩. ৫ মিটার দীর্ঘ। এটি বৃহদাকার পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে।আরবিতে একে বলে আবুল হুল যার ইংরাজি অর্থ ফাদার অফ টেরর।
বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো সভ্যতার একটি গড়ে উঠেছিল মিশরে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার অধিবাসীরা সর্বপ্রথম পিরামিড তৈরি করেছিল। মানব সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম রহস্যময় নিদর্শন হল এই মিশরের পিরামিড। প্রাচীনকালে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে পিরামিডই সবচেয়ে পুরনো এবং অনেকাংশে অক্ষত।
স্পেস স্টেশনে বসে দ্য গ্রেট পিরামিড অফ গিজার ছবি তুলে পাঠিয়েছিলেন জাপানের নভোচর সোইচি নোগুচি ২০২১ সালে। পিরামিডের পাশাপাশি গিজা মরুভূমি এবং লাগোয়া শহরের ছবিও স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে ওই ছবিতে। অনেকেই বলেছেন এ যেন থ্রিডি ইমেজ। পিরামিডের তিনকোনা মাথাগুলো বেশ স্পষ্টভাবেই বোঝা গিয়েছে ওই ছবিতে।
মিশরের গিজার পিরামিড দেখতে ভিড় জমান দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা। গিজার এই পিরামিড প্রাচীন মিশরের আইকনিক ধ্বংসাবশেষ। গ্রানাইট এবং চুনাপাথরের প্রায় ২.৩ মিলিয়ন ব্লক যার গড় ওজন দুই টন। হাজার হাজার বছর ধরে এগুলো এভাবেই রয়ে গেছে। পিরামিড নিয়ে হয়েছে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং গবেষণা তবুও রহস্য ভেদ হয়নি।
২০১০ সালের পরও অনেকবার জাহাজ নিয়ে মিশরে গিয়েছি এবং সুয়েজ ক্যানেল ট্রানজিট করেছি। তবে মিশরের পিরামিড দ্বিতীয়বার আর দেখার সুযোগ হয়নি।
লেখক: মাস্টার মেরিনার ও এক্স ক্যাডেট,বাংলাদেশ মেরিন একাডেমী চট্টগ্রাম।