মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার দাদপুর বিলের পানিতে আশেপাশের ১০ থেকে ১২টি গ্রামের জমির ফসল পানিতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। দাদপুর বিলের স্লুইচ গেট বন্ধ থাকায় স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে ছয় থেকে সাত ফুট পানির উচ্চতা বেশি হয়েছে।
যে কারণে আশেপাশের গ্রামের ফসলি জমিগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। দু’একদিনের মধ্যে স্লুইচ গেট খুলে না দিলে হাজার হাজার বিঘা জমির ফসল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহাজনপুর ইউনিয়নের গোপালনগরের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে দাদপুর বিল। ১০৯ একর পরিমাণের এ বিলটি গ্রামের মৎস্যজীবীরা দীর্ঘদিন ধরে জেলা প্রশাসনের কাছে থেকে লিজ নিয়ে মাছ চাষ করে আসছিলেন।
কিন্তু গত বছর পূর্বের লিজগ্রহিতাদের না জানিয়ে মেহেরপুর সদর উপজেলার পিরোজপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস ও মুজিবনগর উপজেলার মহাজনপুর ইউপি চেয়ারমান আমাম হোসেন মিলু কোমরপুর গ্রামের অনন্তু হালদার ও নগেন হালাদারকে ক্রমান্বয়ে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করে গোপালপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি নামের একটি সমিতি গঠন করেন। পরে ওই সমিতির নামে ভ্যাট বাদে ১৫ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকায় লিজ গ্রহণ করেন।
আব্দুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও আমাম হোসেন মিলু মুজিবনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ক্ষমতার বলয়ে থেকে গোপালপুরের সাধারণ মৎস্যজীবীদিদের বঞ্চিত করে তাঁরা বিলটি লিজ নিয়েছেন বলে অভিযোগ গ্রামবাসীর।
কয়েকদিন ধরে অতিবৃষ্টির কারণে বিলটির পানি স্বাভাবিকের থেকে ৬/৭ ফুট উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আশেপাশের গ্রামের হাজার হাজার বিঘা জমির ফসল পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বিলটির প্রবেশমুখে যাদুখালী স্কুল এন্ড কলেজে নিচে কেটি স্লুইচ গেটের মাধ্যমে ভৈরব নদের সাথে পৃথক করা হয়েছে। স্লুইচ গেটটি খুলে দিলে বিলের পানি ভৈরব নদে মিশে গেলে ফসলের ক্ষতি থেকে কৃষকরা মুক্ত হয়। কয়েকদিন ধরে অতিবৃষ্টি হলেও এদিকে ভ্রুক্ষেপ করেননি লিজ গ্রহীতারা।
স্থানীয় চাষী জামিরুল ইসলাম জানান, তিনি দেড় বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন বিল সংলগ্ন ইছাখালীর মাঠে। তার পুরো ধান পানির নিচে ডুবে আছে। দুএকদিন থাকলেই সব মরে যাবে।
গোপালপুর গ্রামের দয়াল জানান, তার মরিচ আছে পনের কাঠা, কলা আছে এক বিঘা, দুই জমিতেই দুই ফুট করে পানি জমে আছে।
সাইদ জানান, তার সিম, মরিচ, পেঁপে চাষ রয়েছে। গোপালপুর গ্রামের মিঠুন জানান তার সাড়ে চার বিঘা জমিতে আবাদি ফসল সব ডুবে গেছে। একই গ্রামের আব্দুস সালামের দুই বিঘা জমির সিম ডুবে গেছে। কয়েকদিন ধরে বিলের মালিকদের বলার পরেও তারা পানি ছাড়ার ব্যবস্থা নেয়নি।
গোপালপুর গ্রামের কামরুল হাসান, নজরুল ইসলাম, খন্দকার মুনতাজ, বশির আহমেদ, আকুল মন্ডল। তাঁরা সবাই জানান, গোপালপুর গ্রামে প্রায় কয়েক হাজার বিঘা জমিতে ধান, পাট, সবজির চাষ আছে। যে গুলো ডুবে যাওয়ায় হুমকির মুখে রয়েছে। বাবলু বিশ্বাস ও মিলু চেয়ারম্যান লিজ নিয়ে অনন্ত হালদার ও নগের হালদারের নামে বিলটি চাষ করছেন।
জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি ও গোপলপুরের বাসিন্দা আব্দুল হামিদ জানান, পূর্বের লিজদাতাদের আপত্তি থাকলেও কিভাবে নতুনদের লিজ দেওয়া হয়েছে তা বোধগম্য নয়। বর্তমানে পিরোজপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও মহাজনপুর ইউপি চেয়ারম্যানের সরাসরি তদারকিতে কোমরপুরের দুইজনকে দিয়ে কমিটি করে লিজ নিয়ে বিলটি চাষ করা হচ্ছে। নিজ গ্রামে বিলটি থাকার পরও মৎস্যজীবীরা বঞ্চিত হচ্ছে। একই সঙ্গে অতিবৃষ্টির কারণে গোপালপুর সাধারণ কৃষকদের ফসল নষ্ট হচ্ছে। যেটা এর আগে কখনো হয়নি।
দাদপুর বিলের পূর্বের লিজ নেওয়া গোপালপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি রেজাউর রহমান নান্নু বলেন, স্লুইচ গেট আটকিয়ে রেখে সাধারণ চাষীদের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। দুই তিন দিনের মধ্যে পানি ছাড়া না হলে ধান,পাটসহ বিভিন্ন আবাদি সবজি সবগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। আজ মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে আবেদন করেছি। দু’একদিনের মধ্যে স্লুইচ গেটের সব দরজা খুলে না দিলে গোপালপুরের সাধারণ কৃষকদের সাথে নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে যাব।
লিজ সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি বলেন, ২৫ বছর যাবৎ এই বিল গোপালপুরের মানুষকে নিয়ে চাষ করে আসছি। অথচ আমাদের না জানিয়ে বা আমাদের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও কিভাবে অন্যদের লিজ দেওয়া হলো তা বুঝলাম না। বিলটির লিজের সাথে মহাজনপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আমাম হোসেন মিলু সরাসরি জড়িত । তার তত্ত্বাবধানে চাষ হচ্ছে।
দাদপুর বিল লিজ নেওয়া গোপালপুর মধ্যপাড়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক নগেন হালদার হলেও তার বাড়ি পাশের কোমরপুর গ্রামে। তিনি বলেন, স্লুইচ গেট বন্ধ থাকার কারণে বৃষ্টির পানিতে ফসলের ক্ষতি হয়েছে এটা আমি দেখেছি এবং শুনেছি। আমি দুই চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস ও আমাম হোসেন মিলুকে বলেছি স্লুইচ গেটের পানি ছেড়ে দেওয়ার জন্য।
বিল চাষ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা কার্যকরি কমিটিতে ২১ জন সদস্য আছি। কতজন শেয়ার আছে আমি বলতে পারবো না। দুই চেয়ারম্যান বাবলু বিশ্বাস ও মিলুর মাধ্যমে আমরা দাদপুর বিলে মাছ চাষ করছি। আমি এ ছাড়া আর কিছু বলতে পারবো না।
মহাজনপুর ইউপি চেয়ারম্যান বিলের লিজ গ্রহণের কথা অস্বীকার করে বলেন, সার্কুলারের মাধ্যমে একটি মৎস্যজীবী সমিতি লিজ নিয়ে চাষ করছে। অতিবৃষ্টির কারণে কিছু ফসলি জমি ডুবে গেছে জানার পর স্লুইচ গেট খোলার জন্য মিস্ত্রি নিয়ে এসে কাজ করানো হচ্ছে।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মাসুদুল আলম জানান, স্লুইচ গেট বন্ধ থাকায় আবাদি জমি প্লাবিত হয়েছে এটা শুনেছি। আজকের উপজেলা পরিষদের মিটিংয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ বিশ্বাসকে পানি ছাড়ার ব্যবস্থার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উসমান গনি জানান, কৃষকদের অভিযোগ পাওয়ার পর আমি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি। পানি জমে থাকার কারণে বহু জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। দু’একদিনের মধ্যে স্লুইচ গেট খুলে না দেওয়া হলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হবে। পাঁচটি গেটের মধ্যে তিনটি গেট যে কোন উপায়ে খুলতেই হবে। গেট খুলতে মিস্ত্রিরা কাজ করছে। আমি বিষয়টি তদারকি করছি।