তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করতে নানা লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে কৃষকদের প্রলুব্ধদ্ধ করছে তামাক কোম্পানীগুলো। সার, কিটনাশক, নগদ টাকা ও তামাক পরিচর্যা ও পোড়ানো পর্যন্ত জুতা, হ্যান্ডস গ্লাবস ও পিপি দিচ্ছেন কোম্পানীগুলো শুধু তামাক ফসলের উপরই নির্ভর করে এসব কোম্পানীগুলো দু ধরনের ব্যবসা করছেন কৃষকদের সাথে। তারা তামাক কিনেও ব্যবসা এবং সার কীটনাশকসহ অন্যান্য উপকরণ বিক্রি করেও করছেন মোটা অংকের মুনাফা। এতে কৃষকরা যেমন কোম্পানীগুলোর কাছে উচ্চ মূল্যে সার কীটনাশক কিনতে হচ্ছে, আবার তামাক বিক্রি করতে গিয়েও নানাভাবে হয়রানীর শিকার হচ্ছে।
স্বরে জমিনে ঘুরে দেখা গেছে, মেহেরপুর জেলার বিভিন্ন মাঠে দিগন্ত জুড়ে চলছে তামাকের চাষ। বিস্তির্ণ মাঠ জুড়ে তামাক চাষের ফলে খাদ্য শস্য চাষ কমছে আশংকাজনক হারে। তামাক চাষের ফলে প্রতি বছর এ জেলা থেকে কয়েক লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্য শস্য উৎপাদন কমছে। এছাড়া তামাক আবাদের কারণে বাড়ছে ক্যানসার, হাফানিসহ নানা ধরনের জটিল রোগ। এছাড়া আাশংকাজনকহারে বেড়েছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা।
জেলার বিস্তির্ণ মাঠ জুড়ে তামাকের চাষ হলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট কৃষি অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তামাক চাষ বন্ধে কোন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়না কখনো। তামাক চাষ নিয়ে প্রশাসনের উদাসীনতা এতটাই যে, জেলায় কি পরিমাণ তামাক চাষ হয়েছে সে হিসেবটাও দিতে পারেনা সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়ীপ্রাপ্তরা।
তামাক চাষের আগ্রাসনে জেলাবাসির স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন বাড়ছে। তেমনি, হুমকীর মুখে পড়েছে শাক সব্জী ও খাদ্য শস্য’র চাষ। সেই সাথে ধীরে ধীরে কমছে মাটির উর্বরা শক্তি।
এলাকায় তামাক চাষের ফলে ঝুকির মধ্যে বেশী পড়ছে জেলার নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্য। কারন, দিন মজুর শ্রেনীর মানুষ সরাসরি তামাক চাষ থেকে শুরু করে গাছ থেকে পাতা ছোঁড়ানো, পোড়ানো ও বেল বাঁধা পর্যন্ত সকল কাজই করে থাকেন তারা ।
জেলায় তামাক চাষ বেড়ে যাওয়ায় আগের তুলনায় খাদ্য শস্য উৎপাদন কমেছে আশংকাজনক হারে। জেলায় আগে যেসব জমিতে ধান, গম, পাট, ভূট্টা, আলুসহ নানা ধরনের সবজীর চাষ হতো সেখানে আজ তামাকের চাষ হচ্ছে। তামাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষকদের লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে তাদের তামাক চাষে আগ্রহী করে তুলছে। চাষের আগেই বীজ ও নানা ধরনের সার কীটনাশক দিয়ে কৃষকদের নীল করদের মত কিনে নিচ্ছে এসব তামাক কোম্পানীগুলো।
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বাওট, নওদা হোগলবাড়িয়া, বামুন্দী, দেবীপুর, করমদী, নওপাড়া, কাজীপুর, মটমুড়া, আকুবপুর, ছাতিয়ান, মুন্দা, মাঝেরগ্রাম, চরগোয়ালগ্রাম, কুঞ্জনগর, সহবাড়িয়া, মোমিনপুুর, নওদা মটমুড়া, বেতবাড়িয়া, কল্যাণপুর, সাহারবাটি, চেংগাড়া, আমতৈল, মানিকদিয়া, সিন্দুর কৌটা, বাদিয়াপাাড়া,ধানখোলা, মহিষাখোলা, গাঁড়াডোব, গাঁড়াবাড়িয়া, সানঘাট, সদর উপজেলার মদনাডাঙ্গা, আমঝুপি, বারাদী, চাঁদবিল, শ্যামপুর, শালিকা, চকশ্যামপুর, নুরপুর, মুজিবনগর উপজেলার মোনাখালিসহ বিভিন্ন গ্রামের দিগন্ত জুড়ে বিস্তৃর্ণ মাঠে তামাকের চাষ হচ্ছে।
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক (ডিডি) কৃষিবিদ স্বপন কুমার খা জানানআমাদের কাছে তামাক চাষের কোনো তথ্য থাকেনা।
তবে মেহেরপুর জেলায় বিগত ৫/৬ বছরের আগের গড় হিসেব অনুযায়ী তামাকের চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর আগে এ অঞ্চলে খাদ্য শস্য ও সবজী উৎপাদন করতো কৃষকরা।
কৃষিবিদ স্বপন কুমার খা আরো জানান, তামাক চাষের ফলে জমির উর্বরা শক্তি মারাত্বক ভাবে কমে যাচ্ছে। একই জমিতে কয়েক বছর তামাকের চাষ করার ফলে জমিতে অর্বান্কী নামের এক ধরনের আগাছা জন্মে। আর এ আগাছা জমিতে একবার জন্মালে সে জমিতে আর কখনো অন্য ফসলের চাষ করা সম্ভব হয়না। এ চাষটি মোটেও পরিবেশ বান্ধব নয়। তামাক চাষের ফলে পরিবেশ মারাত্বক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
কৃষকদের তামাক চাষে নিরুৎসাহীত করতে কৃষি অধিদফতরের পক্ষ থেকে নানা ধরনের কাজ করা হয় বলেও জানালেন তিনি। বিভিন্ন স্থানে কৃষকদের সাথে মাঠ দিবস, পরামর্শ দানসহ বিভিন্ন সময়ে কৃষকদের তামাক চাষে নিরুৎসাহীত করা হয়ে থাকে।
উপ-পরিচালক এসএম মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ৩ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ করলে প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন ধান এবং গমের চাষ করলে প্রায় ১৫ হাজার মেটিকটন দম উৎপাদন হতো। যা দেশের খাদ্য’র চাহিদা মেটাতো পারতো। তামাক চাষ শুধু ক্ষতিকরই না অত্যন্ত অলাভ জনক। তামাক চাষের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত খরচ হিসেবে করলেই তার প্রমান মিলে।
ভমরদহ, নওপাড়া, ভাটপাড়া ও বাওট গ্রামের কয়েক জন তামাক চাষী নাম প্রকাশ না করর শর্তে জানালেন, তামাক কোম্পানী গুলোর শর্ত সাপেক্ষে সার কীটনাশক প্রদানসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদানের জন্যই মুলত চাষীরা ঝুকে পড়েছে তামাক চাষে।
তারা জানান, প্রতি বছরই আমি ৭ থেকে ৮ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করি। তামাকের সাথে অন্যান্য ফসলেরও সামান্য চাষ করি। কিন্তু অন্যান্য ফসলের চাষে লোকসান গুনতে হয়। লাভের চেয়ে খরচ বেশী হয়। তাই অন্যান্য ফসলের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তামাকের চাষ করি। তামাক চাষে পরিশ্রম বেশী হলেও দামটা বেশী পাওয়া যায়।
হোগলবাড়িয়া গ্রামের চাষী জনৈক তামাক চাষী জানান, এবার ৬ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করছেন। এর আগের বছরে ধান চাষ করেছিলাম। ধানের দাম ভালো না পেয়ে গত দু বছর তিনি সবজি চাষের পরিবর্তে তামাকের চাষ করছি। কোম্পানীর দেয়া শর্ত মেনে নিয়ে তিনি সার ও কীটনাশক পেয়েছেন তাই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তামাক চাষ করছেন। তবে তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক জানার পরও তামাক করতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানালেন তিনি।
সরজমিনে গাংনীর বিভিন্ন মাঠ ও গ্রামে পরিদর্শন কালে দেখা গেছে চাষীরা তামাকের পরিচর্যায় ব্যাস্ত সময় পার করছেন। তামাকের কাজে পুরুষদের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরাও ব্যাস্ত রয়েছেন।
এসব তামাক পোড়ানোর জন্য জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রায় সহস্রাধিক তামাক ঘর (তামাকের চুল্লি) বানানো হয়েছে। আর এসব চুল্লিতে ব্যবহার করা হচ্ছে হাজার হাজার টন জ্বালানি খড়ি। এসব জ্বালানি খড়ির ব্যবস্থা করতে কাটছে গাছ। গাছের কাঠ দিয়ে তামাক পোড়ানোর ফলে বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে। পরিবেশের উপর মারাত্বক আঘাত আসছে।
তামাক নিয়ে কর্মরত বিভিন্ন এনজিও চাষীদের তামাক চাষের ক্ষতিকর তুলে ধরে বিকল্প ফসল আবাদ করার পরামর্শ দিলেও তা মানতে নারাজ কৃষকরা।
বৃটিশ আমেরিকান টোবাকোর (বিএটিবি) মেহেরপুর লিফ ডিপোর ম্যানেজার কামাল হোসেন জানান, এ জেলায় আমাদের প্রায় এক হাজার চুক্তিবদ্ধ তামাক চাষী রয়েছেন। এসব তামাক চাষীরা প্রায় ৯ শ একর জমিতে তামাকের চাষ করেছেন। আমাদের কোম্পানী চুক্তিবদ্ধ এসব চাষীদের কাছ থেকে ৯ লাখ কেজি তামাক কেনার লক্ষমাত্রা আছে। তবে তিনি আরও বলেন, আমাদের চুক্তিবদ্ধ কুষক ছাড়াও আর দুই গুন বেশী কৃষক ও জমিতে তামাকের আবাদ হয়েছে বলে জানান তিনি।
জেলায় বৃটিশ আমেরিকান কোম্পানী ছাড়াও জার্মান টোব্যাকো (জিটিআই), আকিজ কোম্পানী তামাক ক্রয় করে থাকেন।
তবে তামাক ক্রয় করাকে কেন্দ্র করে এলাকায় বিভিন্ন সময়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বেড়ে যায় বলে জানান ভূক্তভোগীরা। তামাকের বাইন বসা ও দাম নির্ধারণ ও পূর্জি নিয়ে প্রতি বছরই হট্টগন্ডগোল হওয়ায় আইনশৃংখলা পরিস্থিতি মারাত্বক অবনতিও ঘটে। এলাকার মাস্তান ও এক শ্রেনীর ব্যবসায়ীদের সাথে আতাত করে তামাক কোম্পানীর লোকজনের তামাক ক্রয় করে থাকেন। যার কারনে প্রতারনার স্বীকার হন কৃষকরা।
গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা.এমকে রেজা জানান, তামাকে ক্ষতিকারক উপাদান রয়েছে। যা মুখে বলে শেষ করা যাবেনা। ধুমপান করার কারণে অধিকাংশ লোকই নানা রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। তামাকের উচ্ছিষ্ট অংশ হৃদপিন্ডে ঢুকে ক্যান্সার, হৃদরোগ সহ নানা ধরনের মরণ ব্যাধি হতে পারে। যারা তামাক চাষের সাথে জড়িত বিশেষ করে তামাকের শ্রমিকরা এক সময় হৃদ রোগ ক্যান্সারসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হবে। রোগে তাদের বাঁচানো সম্ভব হবেনা।
এজন্য তামাক চাষ বন্ধ করে বিকল্প ফসলের আবাদ করার ও তামাক চাষের ক্ষতি তুলে ধরে সরকারীভাবে এখনি সেমিনার করা জরুরী বলে জানালেন তিনি। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগককে অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে হবে।
তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক জানা স্বাত্বেও বিভিন্ন তামাক কোম্পানীর লোভনীয় প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে জেলার চাষীরা কোমর বেঁধে নেমেছে তামাক চাষে। তাই সরকারীভাবে উদ্যোগ নিয়ে কৃষি বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের যৌথ ভাবে কাজ করে কৃষকদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি ও আইনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী জানিয়েছেন অভিজ্ঞমহল।