মেহেরপুর শহরের শিশুবাগান পাড়ার ৩টি পরিবারের শিশু ও নারীসহ ১৩ জনকে জঙ্গি সন্দেহে পুলিশের এনটি টেরিরিজম ইউনিটের (এটিইউ) একটি টিম তুলে নিয়ে গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তারা সকলেই নিষিদ্ধ সংগঠণ জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সক্রিয় সদস্য ছিলেন বলে জানা গেছে। এ ঘটনার পর থেকে একজন নিরুদ্দেশ হয়েছেন। তবে ৫ শিশূকে পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়া হয়েছে।
গত ২ আগষ্ট দিবাগত রাতে শহরের শিশু বাগানপাড়া এলাকার ইদ্রিস আলী মিস্ত্রির ছেলে স্ট্রিট ফুড বিক্রেতা আনোয়ার হোসেনকে (৩০) তার বাড়ি থেকে আইনশৃংখলা রক্ষাকারীর পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যায়।
আনোয়ার হোসেনকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে প্রতিবেশি সেন্টু হোসেন ও পলাশ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় মেহেরপুর সার্কিট হাউসসহ বিভিন্ন স্থানথেকে তাদের আটক করেছে বলে পলাশের পরিবারের লোকজন জানিয়েছেন।
তারা হলেন- শিশু বাগানপাড়ার কিতাব আলীর ছেলে সেন্টু হোসেন (২৮), তার স্ত্রী দিলরুবা খাতুন (২৫), ছেলে লাসিন ও হুজাইফা, একই পাড়ার রিকসা চালক পলাশ (৫৫), তার স্ত্রী ফাতেমা খাতুন (৪৮), মেয়ে ফারহানা, প্রিয়া খাতুন, জামাতা ঝন্টু মিয়া, ছেলে ফরহাদ হোসেন, ফয়সাল হোসেন, নাতি বুখারি হোসেন, পলাশের আরেক মিনারুল ইসলাম, নাতনি মিতা খাতুন, রিতা খাতুন ও শাহিনুর।
এদিকে, ঘটনার পর থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছেন একই পাড়ার মাংস বিক্রেতা রফিকুল ইসলামের ছেলে রকিব মোল্লা ওরফে মুজাহিদ (৩০)।
এদের মধ্যে বুখারি, ফয়সাল, মিতা, লাসিন ও হুজাইফা শিশু হওয়ায় গত মঙ্গলবার মেহেরপুর জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের মাধ্যমে তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে ফেরৎ দেওয়া হয়েছে।
তবে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের এক প্রতিবেশী বলেছেন, আটকরা সকলেই জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সক্রিয় সদস্য ছিলেন। পুলিশের কাছে এই তালিকায় ১৮ জনের নাম আছে বলেও জানান তিনি।
আনোয়ার হোসেনের মা আনোয়ারা খাতুন ও পিতা ইদ্রিস আলী মিস্ত্রি বলেন, ছেলেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় তাদের দুজনের পরনে পুলিশের পোশাক এবং অন্যরা সাদা পোশাকে ছিল।
আনোয়ারের স্ত্রী পলি খাতুন বলেন, তারা বলেছিলেন, দু একটা কথা জিজ্ঞাসা করে এখনি ছেড়ে দিয়ে যাবেন। সেই যে নিয়ে গেলো তারপর থেকে আর কোনো খোঁজ পাইনি।
তারা বলেন, আনোয়ারকে নিয়ে যাওয়ার কয়েকবার মেহেরপুর থানা, র্যাব অফিসে গিয়েছি। কোনো খোঁজ পাইনি। সেখানে না পেয়ে তারা জেলার অন্যান্য উপজেলার পুলিশ স্টেশন, র্যাব ও ডিবি অফিসে সন্ধান করেছি। কিন্তু সেসব জায়গায়ও আনোয়ার হোসেনকে পাওয়া যায়নি। থানায় জিডি দিতে গেলেও থানা পুলিশ জিডি নেননি।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একটি সুত্র থেকে জানা গেছে, আটককৃতরা জঙ্গি সংগঠণ জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সক্রিয় সদস্য। তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে ঢাকা থেকে পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিটের একটি গ্রুপ মেহেরপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহযোগীতায় তাদের আটক করে ঢাকায় নিয়ে গেছে। আটককৃত ৬ শিশুর মধ্যে ৫ জন শিশুকে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের মাধ্যমে তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিকট ফেরৎ দিয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সেন্টু হোসেন ও আনোয়ারের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পরিবারের সবাই বারান্দায় বসে আছেন। তাদের সান্ত্বনা দিতে পড়শীদের কয়েকজনও সেখানে আছেন। এছাড়া পলাশ ও রাকিব মোল্লার বাড়িতে গিয়ে তাদের বাড়িতে তালা মারা দেখা গেছে। পলাশের ফেরৎ দেওয়া ছেলে ফয়সাল ও ফরহাদের ছেলে বুখারীকে পাওয়া যায়নি। তারা তাদের কোন আত্মীয়র বাড়িতে গেছে তাও বলতে পারেনি প্রতিবেশীরা।
সেন্টু হোসেনের দুই ছেলে লাসিন ও হুজাইফাকে ফেরৎ পেয়েছেন তার দাদী আদরী খাতুন। এর মধ্যে হুজাইফার একটি পা ভেঙ্গে গেছে। সেন্টুর মা আদুরী খাতুন বলেন এই দুটি দুধের শিশু নিয়ে আমি এখন কি করবো। কুল কিনারা পাচ্ছিনা।
বোন পাপিয়া খাতুন বলেন, আমার ভাইকে ধরে নিয়ে কোথায় রেখেছে সেটা তো আমরা জানার অধিকার রাখি। তারা অন্যায় করলে সাজা হোক। কিন্তু আমাদের পরিবারকে খোঁজ দিক।
আনোয়ার হোসেনের মা আনোয়ারা খাতুন জানান, রাত ১টার পরপরই দুজন পুলিশের পোশাক পরে, চারজন সাদা পোশাকে প্রাচীর টপকে বাড়িতে প্রবেশ করে। আইনের লোক পরিচয়ে ছেলেকে তুলে নিয়ে যায় জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলে। সকালে থানায়, ডিবি কার্যালয়, র্যাব ক্যাম্পে গেলে কেউ স্বীকার করেনি ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার কথা।
আনোয়ারের স্ত্রী পলি খাতুন বলেন, ‘স্বামীর সন্ধানে অনেক জায়গায় গিয়েছি কোথাও সন্ধান মিলল না। আমার স্বামী নিরপরাধ। তাকে কেন রাতের আঁধারে তুলে নেওয়া হলো তা বুঝতে পারছি না।’
প্রতিবেশী জাহিদ হোসেন বলেন, আনোয়ার ফুট পথে ব্যবসা করতো। তবে, নিয়মিত মসজিদে আসার আহ্বান জানাতেন। ধারণা করা হচ্ছে, জঙ্গি সম্পৃক্ততার সন্দেহে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন তাকে তুলে নিয়ে গেছে। তবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত বিষয়টি পরিবারটিকে জানানো। যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে না নিয়ে থাকে তাহলে তাদেরই উচিত আনোয়ারকে খুঁজে বের করা।
মেহেরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম বলেন, মেহেরপুরের পুলিশের কাছে এ বিষয়ে কোন তথ্য নেই। অন্য কোনো সংস্থা তাদের আটক করেছে কিনা তাও জানা নেই।