মেহেরপুরে চাহিদার দ্বিগুণ কোরবানির পশু প্রস্তুত করেছে খামারিরা। ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে জেলার প্রতিটি বাড়ি খামারে পরিণত হয়েছে। অধিকাংশ গ্রামগুলোর এমন কোন বাড়ি নেই, যেখানে কোরবানী উপযোগ্য দু একটি পশু নেই। কৃষি নির্ভর এ জেলায় পশুখাদ্য সহজলোভ্য হওয়ায় সখের বশেও এখান মানুষ গরু, ছাগল পালন করে থাকেন। কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে যে সকল পশু বিক্রির তোরজোড় থাকে তাদের মাঝে। কোরবানির শেষ সে সকল পশু পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন খামারিরা।
মেহেরপুর জেলা প্রাণী সম্পদ অফিসের তথ্যমতে, জেলায় ২৯ হাজার ৪৩০টি বানিজ্যিক খামার ও প্রতিটি বাড়িতে গরু ছাগল পালন করা হয়। এসব খামার ও পারিবারিক খামার থেকে কোরবানিযোগ্য পশু উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার ৫২০টি। কোরবানির জন্য মেহেরপুর জেলার চাহিদা রয়েছে ৯০ হাজার ১১২ টি পশু। বাকি প্রায় এক লাখ কোরবানিযোগ্য পশু ঢাকা, চিটাগাং, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছেন খামারীরা।
জেলার প্রতিটি কৃষকের বাড়িতে দু-একটি করে গরু, ছাগল লালন-পালন হয়ে থাকে। প্রতিটি বাড়ির ব্যক্তিগত খামারে গরু-ছাগল-ভেড়া রয়েছে। মেহেরপুরে বেশ কয়েকটি ছাগল ও ভেড়ার বাণিজ্যিক খামার থাকলেও পারিবারিক খামারে অসংখ্য ছাগল ও ভেড়া পালিত হচ্ছে। কোরবানির ্ঈদকে লক্ষ রেখে বসতবাড়িতে দু-একটি গরু পালন করা প্রধান কাজ।
জেলার গরু খামারে দেশীয় জাতের পাশাপাশি নেপালী, অস্ট্রেলিয়ান, ফিজিয়ান, হরিয়ানাসহ নানা জাতের গরু মোটাতাজা করা হয়েছে।
গাংনী উপজেলার মালশাদহ গ্রামের গরু খামারি মনজুরুল ইসলাম বলেন, আমার খামারে ২৭টি গরু পালছি। ৪০ লাখ টাকার গরু বিক্রি করেছি। আমার খামারে এবছর পাকিস্তানী সাওয়াল ও দেশী গরু ছিল। গরু বিক্রিতে আমি ভাল দাম পেয়েছি। গরুকে দেশী ঘাস, সুষম খাবার ও খুদ কুড়া খাওয়ানো হয়েছে।
গাংনী উপজেলার বানিয়াপুকুর গ্রামের গরু খামারী জোয়াদ আলী। এলাকার সব চেয়ে বড় খামারী হিসেবেই পরিচিত জোয়াদ আলী। তার খামারে এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক গরু রয়েছে।
জোয়াদ আলী বলেন, এই বছর গরুতে আমার লস হবে। এখন পর্যন্ত তার খামারের মাত্র ২ টা গরু বিক্রি হয়েছে। ৪৮ টি গরু খামারে রয়েছে। তিনি বলেন, অন্য বছরে ঢাকা কুমিল্লা বা দেশের অন্যান্য স্থান থেকে গরু কিনতে সোজা চলে আসতেন। তারা আমাদের কাছে সরাসরি গরু কিনতেন। কিন্তু এবছরে তারা গরু কিনতে আসেনি। আমার গরুও বিক্রি হয়নি। তিনি বলেন, আমার খামারে অনেক বড় বড় গরু তাই ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছেনা সহজে।
বাওট গ্রামের সাবেক মেম্বর আশরাফুল ইসলাম কালু বলেন, কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে বাওট গ্রামে প্রতিটি বাড়ি বাড়ি দু একটি গরু ও ছাগল পালন করেন। ঈদের আগেই সেই পশুগুলো বিক্রি করেন তারা।
এদিক, গতকাল শুক্রবার মেহেরপুরে বামন্দী পশু হাটের প্রচুর পরিমানের পশু আমাদানী হলেও সে পরিমাণে ক্রেতার দেখা মেলেনি। শুক্রবারে বামন্দীতে বড় হাট থাকায় মেহেরপুর পশু হাটে তেমন গরুর আমদানী দেখা যায়নি। আগামী মঙ্গলবার মেহেরপুর পশু হাটে অধিক পরিমানে পশু আমদানি হবে ধারণা করছেন ব্যবসায়ীরা।
বামন্দী পশু হাটে গিয়ে দেখা যায় ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশি। শেষ পর্যন্ত কোরবানির পশুর দামও অনেকটা কমেছে। গেল কয়েক সপ্তাহের হাটগুলোতে বিক্রেতারা অতিরিক্ত দাম হাঁকার কারণে ক্রেতারা বিমুখ হয়। শেষ সময়ে এসে ক্রেতারা এখন গত কয়েক হাটের দামের চেয়ে তূলনামূলক অনেক কম দামেই পশু কিনতে পারছেন। ক্রেতা সংকটে কেউ অতিরিক্ত দাম হাঁকাচ্ছে না। ১০ দিন আগে ১শ’ কেজি মাংস হবে এমন গরুর দাম ছিল অন্তত ৮০-৯০ হাজার টাকা। তবে এখন সেসব গরু কেনা-বেচা হচ্ছে ৬০-৬৫ হাজার টাকায়।
প্রান্তিক খামারিরা প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজা করে হাটে নিয়ে এসেছেন। হাটে বড় গরুর তুলনায় মাঝারি গরুর চাহিদা বেশি রয়েছে।
গরু বিক্রেতা আব্দুল আওয়াল বলেন, গত দুই হাটে গরুর দাম ভালো ছিলো কিন্তু আজকে বিক্রেতা কম থাকায় গরুর দাম অনেকটা কমে গেছে। তবে আশানুরূপ লাভ হচ্ছে বেপারীদের।
আরেকজন গরু বিক্রেতা শাহিন আলম বলেন, গত সোমবারের হাটে ৩টা গরু এনেছিলাম। ২টা গরু ভালো দামেই বেঁচেছি আর একটা গরু ফেরত নিয়ে গিয়েছিলাম। ১শ’ কেজি গোস্ত হবে এমন ওজন গরুটির। সেদিন হাটে দাম বলেছিল ৮০ হাজার টাকা। আর আজকের হাটে দাম বলছে ৬০-৬৫ হাজার টাকা।
বামন্দী পশুহাটে ঢাকা থেকে গরু ক্রয় করতে এসেছেন হাজী আবু সাইদ। তিনি বলেন, পর্যাপ্ত গরু রয়েছে। পছন্দ মতো গরু কম দামেই কিনতে পেরেছি। আমি প্রতি বছর এই পশুহাট থেকে কোরবানির পশু কিনে নিয়ে যায়। আমারা চার ভাই চারটি গরু কিনেছি তবে খুব একটা বড় না, মাঝারি গরু কিনেছি।
বামন্দী পশুহাটের ইজারাদার আমিরুল ইসলাম শেখ বলেন, আমরা সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি। পুলিশের টিম রয়েছে। যাতে করে কোন বেপারী ও খামারিদের কোন হয়রানি না হয় সেজন্য আমরা সতর্ক রয়েছি। আর রাজধানী ঢাকা থেকে অনেক ক্রেতা এসেছিল তবে আজ খুব কম ক্রেতা রয়েছে জেলার বাইরের। তারা গত হাটে তাদের পছন্দ মতো গরু কিনে চলে গেছে অনেকেই।
মেহেরপুর জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা (ডিএলও) সাইদুর রহমান বলেন, জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবমতে কোরবানিযোগ্য পশু হিসেবে ষাড়-বলদ-গাভী মিলিয়ে ৫৮ হাজার ৮৬৬টি গরু, ৫৯৫টি মহিষ, ১ লাখ ২৮ হাজার ১৬৯টি ছাগল এবং ২ হাজার ৮৯০টি ভেড়া রয়েছে। যা জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার কোরবানি পশুর চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এবার জেলায় কোরবানির উদ্বৃত্ত পশুর সংখ্যা ১ লাখ ৪০৮টি। অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে দ্বিগুনেরও বেশি পশুর যোগান রয়েছে মেহেরপুরে।