মেহেরপুর জেলা রেজিস্ট্রার: বছরে উপরি আয় প্রায় অর্ধ কোটি টাকা !

মেহেরপুর জেলা রেজিস্ট্রার: বছরে উপরি আয় প্রায় অর্ধ কোটি টাকা !

রেজিস্ট্রি অফিসের দুর্নীতি-পর্ব ১
মেহেরপুরের তিন উপজেলার সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকে দলিল সম্পাদন ও নকল দলিলে জেলা রেজিস্ট্রার (ডিআর) সাইফুল ইসলামের বছরে বাড়তি আয় প্রায় অর্ধ কোটি টাকা। জেলা রেজিস্ট্রারের হয়ে এসকল টাকা সংগ্রহ করেন তার অফিসের টিসি সহকারী খায়রুল ইসলাম । অতিরিক্ত এ টাকা না দিলেই অফিসের স্টাফ ও দলিল লেখকদের উপর চালান হয়রানির খড়গ।

দলিল সম্পাদন থেকেই শুধু না, কাজীদের লাইসেন্স নবায়ন, দলিল লেখকদের লাইসেন্স নবায়ন, স্টাফদের বদলি বাণিজ্য, নকলনবিশ থেকে অফিস স্টাফ চাকরি স্থায়ীকরণ ও উপজেলা অফিস নিরাীক্ষাতেও নেন মোটা অংকের টাকা। তার কথা মত কাজ না করলে দেওয়া হয় বদলির হুমকিও। এছাড়াও মাসের অধিকাংশ দিন তিনি অফিস করেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে। অফিসে পরিদর্শনে গিয়ে না পেলে জানানো হয় তিনি ছুটিতে আছেন।

মেহেরপুর জেলা রেজিস্ট্রার সাইফুল ইসলামসহ দেড় শতাধিক জেলা রেজিস্ট্রার, সাব রেজিস্ট্রার, নকলনবিশদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। চলতি মাসের প্রথম দিকে ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার অহিদুল ইসলাম দুদকের মামলা কারাগারে যাওয়ার পর দুর্নীতিগ্রস্থ জেলা রেজিস্ট্রার, সাব রেজিস্ট্রার ও নকলনবিশদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে এসকল কর্মকর্তারা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তার ব্যতিক্রম নন মেহেরপুরের জেলা রেজিস্ট্রার সাইফুল ইসলামও।
সম্প্রতি জেলা রেজিস্টারের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা তিনি অফিসে নেই। তার অফিসের টিসি সহকারী খাইরুল ইসলাম একটি চিঠি দেখিয়ে জানান ডিআর শ্রান্তি বিনোদনের ১৫দিনের ছুটিতে আছেন। তবে, কয়েক মাস আগেও তিনি শ্রান্তি বিনোদনের ছুটি কাটিয়েছেন বলে এক কর্মকর্তা জানান।

জেলা রেজিস্টার অফিসের তথ্য মতে, ২০২৩ সালে মেহেরপুর সদর, মুজিবনগর ও গাংনী সাব রেজিস্টার অফিসে নতুন দলিল সম্পাদন হয়েছে ২০ হাজার ২৪৫টি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১৮৮৯, ফেব্রুয়ারিতে ১৪১৯, মার্চে ২১৭০, এপ্রিলে ৯৯৬, মে মাসে ২২৫০, জুনে ১৮৩৮, জুলাইয়ে ১৮৮৯, আগস্টে ১৯৭৬, সেপ্টেম্বরে ১৫৪৬, অক্টোবরে ১৪৬৯, নভেম্বরে ১৪২২, ডিসেম্বরে ১৩৮১টি দলিল সম্পাদিত হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ওই তিন সাব রেজিস্ট্রি অফিসে নতুন দলিল সম্পাদন হয়েছে ৬ হাজার ৩৮৫ টাকা। যার মধ্যে জানুয়ারিতে ১৮৪০, ফেব্রুয়ারিতে ১৪৭৯, মার্চে ১৮৩৪ ও এপ্রিলে ১২৩২টি দলিল সম্পাদন হয়েছে। সে হিসেবে গড়ে এবছরও ২০ হাজার দলিল সম্পাদন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।

চলতি বছর এ দলিল সম্পাদন করতে জেলা রেজিস্ট্রার সাইফুলকে ইসলাম দলিল প্রতি দিতে হচ্ছে ২০০ টাকা। এই টাকা দলিল লেখকের মাধ্যমে গাংনী সাব রেজিস্ট্রার অফিসের এক স্টাফ হয়ে চলে যায় জেলা অফিসের টিসি সহকারী জেলা রেজিস্ট্রারের মনোনিত খাইরুল ইসলামের হাতে। তবে বিশ^স্তসূত্রে জানা গেছে, জেলা রেজিস্ট্রার এই টাকার মধ্যে কিছু অংশ তার অধিনস্ত স্টাফদের মাঝে বিতরণও করেন। দলিল লেখকরা জানান, ২০২৩ সালে তিনি দলিল প্রতি ১০০ টাকা করে নিলেও ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাস থেকে তিনি দলিল প্রতি ২০০ টাকা করে নিচ্ছেন। আর এ টাকা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করলে সাব রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মচারী ও দলিল লেখকদের উপর নেমে আসে নানা নির্যাতন হয়রানির খড়গ।

এছাড়া ২০২৩ সালে সার্টিফাইড নকল সরবরাহ করা হয়েছে ১৪৭৯২টি এবং ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সার্টিফাইড নকল সরবরাহ করা হয়েছে ৪৮৩৪টি। অভিযোগ রয়েছে প্রতিটি নকল সরবরাহের জন্য জেলা মহাফেজখানা থেকে তাকে ২৫০ টাকা করে নিয়ে থাকেন।

গাংনী সাব রেজিস্ট্রার অফিসের নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন দলিল লেখক জানান, গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত জেলা রেজিস্ট্রারের খাতে দলিল প্রতি ১০০ টাকা করে দিতে হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সাল থেকে তিনি খায়রুলের মাধ্যমে ২০০ টাকা করে আদায় করছেন। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালেই নানা অডিট, পরিদর্শনের ভয় দেখান ।

মেহেরপুর সদর সাব রেজিস্ট্রার অফিস ও মুজিবনগর সাব রেজিস্ট্রার অফিসের কয়েকজন দলিল লেখকের সাথে কথা বলা হলেও তারাও পরিচয় দিয়ে কথা বলতে রাজী হননা কর্মকর্তাদের ভয়ে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারাও বলেন, গত বছর দলিল প্রতি ১০০ টাকা করে নিলেও এবছর ২০০ টাকা করে জোর করে নেওয়া হচ্ছে। ফলে জমি ক্রেতাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

জেলা রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে গাংনী সাব রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে মাঝে মধ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন দলিল লেখকরা। এনিয়ে গত কয়েকমাসে কয়েকদফা মিটিং হয়েছে বলেও জানা গেছে।

গাংনী সাব রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ডিআর অফিসের খাইরুল ইসলাম চাপ দিয়ে ডিআর স্যারের জন্য দলিল প্রতি ২০০ টাকা করে তুলে দিতে বলেন, না দিলে অন্যত্র বদলি করার হুমকি দেন। তিনি আরও বলেন, আমরা ছোট চাকরি করি, স্যারদের কথামত আমাদের চলতে হয়, এর বেশি কিছু বলতে পারবো না।

দলিল লেখকরা আরও অভিযোগ করেন, অফিসের স্টাফ খায়রুলের আচরণ দেখে মনে হয় সে নিজেই ডিআর (জেলা রেজিস্ট্রার)।

গাংনী সাব রেজিস্ট্রার অফিসের দলিল লেখক সমিতির সাবেক সভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন পিন্টু বলেন, ডিআর স্যারের কথা বলতে পারবো না তবে ওই অফিসের কিছু লোক নাম করতে চাচ্ছিনা বলে খাইরুল ইসলাম দলিল প্রতি ২০০ টাকা করে আদায় করার জন্য চাপ দেন। মহুরিরা অস্বীকৃতি জানালে অডিটের নামে হয়রানি শুরু করে। যেমন আগামী কাল (সোমবার) অডিট করবে বলে মৌখিক জানিয়েছে। এসব ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকার জন্য মহুরিরা বাধ্য হয়ে ওই টাকা দেন।

জেলা রেজিস্ট্রার অফিসের টিসি সহকারী খায়রুল ইসলাম সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, জেলা রেজিস্ট্রার কোন টাকা নেন না। তিনিও এ ধরণের কর্মকাণ্ড করেন না।

এ ব্যাপারে জেলা রেজিস্ট্রার সাইফুল ইসলাম বলেন, আমার নামে কোন অফিস থেকে কোন ধরণের টাকা তোলার অনুমতি কাউকে দেওয়া হয়নি। খাইরুল যদি এটা করে থাকে আমি খাইরুলকে সাইজ করবো। অন্যান্য অভিযোগের বিষয়গুলোকে তিনি অস্বীকার করেন। তবে অফিসে কম থাকেন বিষয়টি আংশিক স্বীকার করেছেন।

শ্রান্তি বিনোদনের ছুটির বিষয়ে ডিআর সাইফুল ইসলাম বলেন, এর আগে আবেদন করেছিলাম, ফাণ্ডে টাকা ছিলো না। ফাণ্ডে টাকা আসায় এ মাসে ছুটি কাটালাম।

তবে সহকারী মহাপরিদর্শক নিবন্ধন সালাম আজাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ না করায় কথা বলা সম্ভভ হয়নি।

উল্লেখ্য, জেলা রেজিস্ট্রার মো. সাইফুল ইসলাম ২০২০ সালের ৯ জুন মেহেরপুরে যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকেই এ নিয়মে সাব রেজিস্ট্রার অফিসগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন। (চলবে)…