চা ছাড়া অনেকের দিন চলেই না। চা নিয়ে গবেষণা আর কাব্য তো কম হয়নি। কিছু চা যত পুরোনো হয়, তত স্বাদ বাড়ে। কিছু চা বছরের কেবল একটি নির্দিষ্ট দিনেই সংগ্রহ করতে হয়। আর কিছু চা সোনায় মোড়ানো। শোনা যাক, এমনই কিছু চায়ের আজব গল্প।
মোঙ্গল সাম্রাজ্যের এক রাজার মায়ের ভয়াবহ অসুখ। কোনো পথ্যতেই অসুখ সারে না। সব চিকিৎসাই যখন ব্যর্থ, এমন সময় উয়ি পাহাড়ের চূড়ায় এক ঝোপে পাওয়া গেল দা হং পাও পাতার খোঁজ। এটা আসলে বিশেষ ধরনের চা। এই চা পান করেই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন রাজার মা।
সেই থেকে এখনো দা হং পাও বিশ্বের সবচেয়ে দামি চা। সোনার চেয়েও অন্তত ৩০ গুণ দামি। বিশ্বের বাজারে এই চাকেই সবচেয়ে দামি চায়ের মর্যাদায় রাখতে ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও খুব অল্প পরিমাণে উৎপাদন করা হয়। অবশ্য এই চা উৎপাদনও সহজ কথা নয়। কেননা এই চায়ের আসল স্বাদ পেতে হলে চা–গাছের বয়স হতে হবে অন্তত ৩০০ বছর। এখন অবশ্য উয়ি সম্প্রদায় এই চায়ের গাছ লাগিয়েছে। তবে সেই চায়ের স্বাদ আসলটার কাছাকাছিও নয়। গাছগুলো যত পুরোনো হবে, ততই স্বাদ বাড়বে। দা হং পাও অর্থ লাল রঙের গাউন। টকটকে লাল রঙের এই চা পান করার পর দীর্ঘক্ষণ মুখে লেগে থাকে ফুলের সুবাস।
পিজি টিপস নামটি অনেকের কাছেই পরিচিত। এটা একটা ব্রিটিশ চায়ের কোম্পানি। ৯১ বছর বয়সী এই কোম্পানিটি বিখ্যাত বাজারে ডায়মন্ডের টি-ব্যাগ আনার জন্য। চায়ের কাপে ডায়মন্ডের টি ব্যাগ ভিজিয়ে খেতে প্যাকেটপ্রতি খরচ পড়বে ১২ লাখ টাকা। পিজি টিপসের চা বিরল প্রজাতির সিলভার টিপস ইম্পোরিয়াল চা। আর এর প্রতিটি টি ব্যাগে রয়েছে ২৮০টি ছোট্ট ছোট্ট হিরের টুকরা। সেই হিরের টুকরা আবার সাধারণ হিরের টুকরা নয়। এর কারুকার্য করেছে বিখ্যাত হিরের কোম্পানি বুডলেস জুয়েলার্স। অবশ্য চায়ের এই সংস্করণটি কেবল একবারই বের হয়েছিল। ২০০৫ সালে, কোম্পানিটির ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে। এই চায়ের ব্যাগ বিক্রির টাকার একটি অংশ খরচ হয়েছিল ইংল্যান্ডের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য তহবিল গঠনে।
এই চা-ও চীনের উয়ি পাহাড়েই প্রথম পাওয়া যায়। গাছের হলুদ কুঁড়ি সংগ্রহ করার পর ৬০ শতাংশ জারণ করে সংরক্ষণ করা হয়। স্তরে স্তরে এই চায়ের স্বাদ বদলায়। আর চা যত পুরোনো হয়, ততই এর স্বাদ বাড়ে, সুপেয় হয়। দুই বছর পর পর তাপ দিয়ে এই চায়ের সঙ্গে কাঠ, ফুল আর চকলেট ফ্লেভার দিয়ে পোড়ানো হয়। সাধারণত ৫০ বছর পর বিক্রির জন্য বের করা হয়। প্রতি কেজি চায়ের দাম ৫ লাখ টাকা।
কাঠ, ফুল আর চকলেট ফ্লেভার দিয়ে পোড়ানো এই চায়ের দাম প্রতি কেজি ৫ লাখ টাকা
কাঠ, ফুল আর চকলেট ফ্লেভার দিয়ে পোড়ানো এই চায়ের দাম প্রতি কেজি ৫ লাখ টাকা ছবি: পেকজেলস ডট কম থেকে
সোনার চা খেয়েছেন কখনো?
অবশ্য সরাসরি সোনার নয়, সোনার প্রলেপ দেওয়া। ঘটনা হলো, এই চা–গাছে যখন নতুন কুঁড়ি গজায়, তখন পুরো পাতায় ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া হয়। এই ইয়েলো গোল্ড-টি বাডস বছরের একটি বিশেষ দিনেই সংগ্রহ করা হয়। এই চায়ের কুঁড়ি সংগ্রহ করতেও ব্যবহার করা হয় স্বর্ণের কাঁচি। সাতবার প্রক্রিয়াজাত করার পর বাজারজাত করা হয় দুর্লভ প্রজাতির এই চা। এটিও চীনা চা।
আরেক পদের চা হলো ব্রোকেন লিফ টি। ইউরোপের এই চায়ের বিশেষত্ব হলো চা–গাছের কেবল তিন নম্বর পাতা দিয়েই এই চা হয়। নাম ব্রোকেন লিফ টি হওয়ার কারণ, ইউরোপের এক চা ব্যবসায়ী চীনে এই বিশেষ চা রপ্তানি করতে গিয়ে বুঝতে পারেন, চায়ের পাতা যদি আস্ত না রপ্তানি করে ভেঙে দেওয়া হয়, তাহলে জাহাজে দেড় গুণ চা বেশি ধরে। তখন থেকেই চা–পাতা ভেঙে রপ্তানি করার প্রচলন শুরু হলো। এক কেজি ব্রোকেন লিফ টির দাম ৩৫ হাজার টাকা।
তিয়েগুয়ানিন চা স্বাদে গ্রিন-টির চেয়ে কড়া। এতে ব্ল্যাক টির চেয়ে কম ক্যাফেইন থাকে। এই চা প্রস্তুত করতে হয় একটু সাবধানে। পুরোপুরি ফার্মেন্টেশন করা হয় না। রং বদলানো শুরুর আগেই বন্ধ করে দিতে হয় ফারমেন্ট করা। এই চা খেতে দারুণ। আবার মেদ ঝরাতেও বেশ কার্যকর। তিয়েগুনানিন চা হয় দুই রকম। ৬০ ঘণ্টা ঠান্ডায় রেখে দেওয়া হয়। এতে ঘ্রাণ হালকা আর সুগন্ধী হয়। অথবা ৬০ ঘণ্টা উচ্চ তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয়। সেখানে এটি কালো হয়ে আসে। এটা বেশ কড়া আর ধোঁয়াটে স্বাদের হয়।
প্রতিবছর দামের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়ে ভারতের আসামের মনোহরি গোল্ড টি। এ বছর প্রতি কেজি চায়ের দাম ধরা হয়েছে এক লাখ রুপি বা ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা। গত বছর এই চায়ের দাম ছিল ৭৫ হাজার রুপি। এই চা তৈরির সময় যখন বলক ওঠে, তখন সোনালি আভা ফুটে ওঠে। তা থেকেই এই নামকরণ। এই ভ্যারাইটির চা কেবল মনোহরি টি এস্টেটেই উৎপাদিত হয়। এই চা নিজের বিশেষ সুগন্ধের জন্যও প্রসিদ্ধ। অন্যান্য চায়ের তুলনায় এই চায়ে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের পরিমাণ বেশি। বার্ধক্য আর স্থূলতা নিয়ন্ত্রণে এই চায়ের বিশেষ নামডাক আছে। ভোর চারটা থেকে ছয়টার ভেতর যখন প্রথম সূর্যরশ্মি পাতার ওপর পড়ে, তখন এই চা সংগ্রহ করা হয়। ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়ায় রং বদলানো হয়। শুকানোর পর সোনালি রঙের দেখায়।