আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ সোমবার। দিবসটি উপলক্ষে একটি নিবন্ধন লিখেছেন অভিনেত্রী জয়া আহসান।
দুই বাংলার জনপ্রিয় এ অভিনেত্রীর নিবন্ধনটি কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছে।
জয়া আহসানের নিবন্ধনটি যুগান্তর পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-
‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস এলে আজকাল আমার কাছে শঙ্খ ঘোষের অতিপরিচিত সেই কবিতার চরণটিই মনে ফিরে ফিরে আসে, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।’ পণ্য, ভোগ আর প্রচার—এসবের আতিশয্যে এই দিনটির মহিমা যেন ঢাকাই পড়ে গেছে। কী এক উত্তাল আকাঙ্ক্ষা থেকে এই দিনটির শুরু হয়েছিল, আর কনজিউমারিজমের ধাক্কায় দিনটি আজ কোথায় এসে পড়েছে।
যেই চেতনা থেকে এই দিনটি শুরু হয়েছিল, সেই চেতনাটি ফিরিয়ে আনা দরকার সবার আগে।
কী সেই চেতনা? ১৫ হাজার নারী সেই ১৯০৮ সালে নিউ ইয়র্কের রাজপথে নেমে এসেছিলেন। কেন? তাঁদের দাবি ছিল, তাঁদের কাজের সময়সীমাটা সহনীয় মাত্রায় নেমে আসুক। মজুরি সামান্য বাড়ুক। তাদের ভোটের অধিকার দেওয়া হোক। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় মেয়েরা যে চারদিন ধরে ধর্মঘট করেছিল, তাঁদের দাবি ছিল সামান্য—‘রুটি আর শান্তি’।
ভালোমতো খেয়াল করলে দেখব, আলাদা করে এসবে কিন্তু নারীর জন্য বিশেষ কোনো দাবি নেই। এর সবটাই মানুষ হিসেবে বাঁচারই দাবি। ব্যাপারটাই তা–ই। নারীর দাবি তো আসলে মানুষ হিসেবে জীবন যাপন করারই দাবি।
নারীর এই দাবি সে অর্থে পুরুষের দাবিই বা হবে না কেন? পুরুষদেরও তো নিছক পুরুষ হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেই বাঁচতে হবে। তারা যদি নারীর বাঁচার দাবির অংশ থেকে বেশিটা কেড়ে নেয়, তাহলে যে মনুষ্যত্বের মধ্যেই টান পড়ে।
কিন্তু যে দাবির জন্য মেয়েরা একদিন পথে নেমেছিল, এক শতাব্দীর বেশি সময় পেরিয়ে এসেও সে দাবির কতটা পূরণ হলো তাঁদের? এখনো যখন পথে–প্রান্তরে কলে–কারখানায় নারী শ্রমিকদের এই একই দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে দেখি, বিষণ্ণ হয়ে ভাবি, সভ্যতা তাহলে কত দূর এগোল? হ্যাঁ, আমাদের মতো সমাজের একটি অংশের কাছে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে, এসেছে কিছুটা আরাম। বড় একটা অংশ তো পড়ে আছে বিভেদের দুর্ভাগ্যজনক একটা রেখার তলায়। ওঁদের বাঁচার দাবি এখনো অপূর্ণ।
এ জন্য বলতে চাই উদ্যাপনের চাকচিক্যে যেন নারী দিবসের চেতনাটা আমরা হারিয়ে না ফেলি।
আগের কথা দুটোর আভাসই যেন দেখতে পাই আমাদের দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে। এত এত নারীশ্রমিক যে যুক্ত হলেন এখানে, তাতে কী যে যুগান্তকারী একটা বদল ঘটিয়ে দিলেন তারা দেশের অর্থনীতিতে। বিদেশ থেকে যে ডলার আসছে, সেখানে বড় সংখ্যাটাই এসব দরিদ্র মেয়ের অবদান। তারা বদলাতে এসেছিলের নিজের জীবন, অথচ পাল্টে দিলেন সারা দেশের জীবনধারা। বিনিময়ে নিজেদের জীবন কতটুকুই বা বদলাতে পারলেন তাঁরা? যৎসামান্য।
মেয়েরা যে ঘরে ঘরে কাজ করছেন; সংসার সামলে, পরিবারের সবার ভালোমন্দ দেখে রেখে, সন্তান মানুষ করে শুধু নিজেদের নয়—পুরো সমাজটাকেই তারা এগিয়ে নিচ্ছেন। খবরে পড়েছিলাম, বাংলাদেশের অর্ধেকের কাছাকাছি নারী ঘরের কাজে যুক্ত, পুরুষেরা ১ শতাংশেরও কম। কী করুণ দৃশ্য।
এই আমাদের চারপাশের দেশগুলোর ছবিও তো এর চেয়ে বড় রকমের আলাদা কিছু হওয়ার কারণ নেই। এর হিসেব তো আমরা নিচ্ছি না। এসব নিয়ে কথা হচ্ছে বিস্তর, কিন্তু কোনো একটা জায়গায় আমাদের হৃদয় সেখান থেকে নিদারুণভাবে বিচ্ছিন্ন। সে জন্য কথা হলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
এই যে বৈষম্য, কোভিড–১৯ অতিমারির পরে তা আরও গভীর হয়ে উঠেছে। একটা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, অসম্ভব এই সময়ে মেয়েদের ওপরে যৌন নির্যাতন বহুগুণ বেড়ে গেছে। গবেষণা বলছে, নারী আর পুরুষের মধ্যে গত ২৫ বছরে যতটুকু সমতা এসেছিল, এই অতিমারি সেটি ধুয়ে–মুছে দিয়েছে। গবেষণা বলছে আরও নিষ্ঠুর কথা, আগামী এক শতাব্দীতেও নাকি নারী আর পুরুষের মধ্যে পরিপূর্ণ সাম্য প্রতিষ্ঠার কোনো সম্ভাবনা নেই।
ছবিটি যখন এমনই বিষণ্ণ, রঙিন চশমাটা খুলে তখন সত্যের দিকে সোজা চোখে তাকানো দরকার। উদ্যাপনের আগে দরকার কর্তব্য, আমাদের যার যার দিক থেকে।
আমি এসব কথা যে বলছি, তার মানে এই নয় যে আমি হতাশ। আমি বরং ভীষণভাবে আশাবাদী। কারণ নিজের জীবনে আমি দেখেছি, পথ সব সময়ই এবড়ো–থেবড়োই থাকে। সেই পথ ভেঙেই এগিয়ে যেতে হয়। ইতিহাসে সেভাবেই আমরা এগিয়েছি। তবে এর জন্য দরকার হয় নিরন্তর স্বপ্নের, প্রতিজ্ঞার, অধ্যবসায়ের আর নিজের শক্তির ওপর আস্থার।
আর রবীন্দ্রনাথের এই কথায় তো আমার প্রবল আস্থা যে ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।’ মানুষই পারে অসম্ভবকে সম্ভব করতে। সেখানে সবাইকে নিয়ে বৃহত্তর জীবনে সাধ্যমতো আমাদের যুক্ত হতে হয়, ভালোবেসে হাত বাড়িয়ে দিতে হয়। এটা শুধু মানুষ হিসেবে আমাদের কর্তব্য নয়, মানুষ হিসেবে আমাদের নিয়তি।
আমি নারীর জয়ে বিশ্বাসী। কারণ আমি মানুষের জয়ে বিশ্বাসী।’
Shares
facebook sharing buttonmessenger sharing buttontwitter sharing buttonpinterest sharing buttonlinkedin sharing buttonprint sharing button