ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় থাকা মোট ৯টি কবরস্থানে হঠাৎ বেড়েছে লাশ দাফনের সংখ্যা। মে মাসে দাফনের সংখ্যাকে অস্বাভাবিক বেশি বলছেন কবরস্থান ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা। আগের মাসে কিংবা কোনো এক দিনে ‘এত কবর’ খোঁড়েননি বলে জানিয়েছেন গোরখোদকরাও।
দাপ্তরিক তথ্যানুযায়ী এখন পর্যন্ত আজিমপুর কবরস্থানে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া শুধু চার ব্যক্তির লাশ দাফন করা হয়েছে। সেগুলো হলো—দেশে প্রথম করোনায় মারা যাওয়া আফসার উদ্দিন ভূঁইয়া, সরকারি কর্মকর্তা জালাল সাইফুর রহমান ও তৌফিকুল আলম এবং জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের লাশ।
গত ৩০ মে পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া ১৯১ জনকে কবর দেওয়া হয় খিলগাঁওয়ের তালতলা কবরস্থানে। কিন্তু পরবর্তী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩১ মে থেকে করোনায় মারা যাওয়াদের দাফন করা হচ্ছে রায়েরবাজার কবরস্থানে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়াদের রায়েরবাজার কবরস্থানের বাইরে অন্য কোথাও দাফনের অনুমতি নেই। কিন্তু অন্য কবরস্থানগুলোর সঙ্গে রায়েরবাজারেও মে মাসে বেড়ে গিয়েছিল দাফনের সংখ্যা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আজিমপুর কবরস্থানে এপ্রিল মাসের চেয়ে মে মাসে ২৬১টি বেশি লাশ দাফন করা হয়েছে। এপ্রিল মাসে কবরস্থানটিতে দাফন করা হয় ৭৭৩টি লাশ। কিন্তু মে মাসে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩৪টি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দাফন করা লাশের মাসিক গড় ছিল ৭৭৯.৫০টি। এদিকে চলতি জুন মাসের গতকাল (১৮ জুন) বিকেল পর্যন্তই ৫৭৫টি লাশ দাফন করা হয়েছে এই কবরস্থানে। কবরস্থানটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এ তথ্য জানিয়েছে।
জুরাইন কবরস্থানে এপ্রিল মাসে দাফন করা হয়েছিল ২৭২টি লাশ। কিন্তু মে মাসে কবরস্থানটিতে দাফন করা হয়েছে ৩৭০টি লাশ। অর্থাৎ জুরাইনে এপ্রিলের চেয়ে মে মাসে ৯৮টি বেশি লাশ দাফন করা হয়েছে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে দাফন করা মরদেহের গড় ছিল ২৫৬.২৫ জন। চলতি মাসে গতকাল পর্যন্ত এই কবরস্থানে ১৯৭টি লাশ দাফন করা হয়েছে।
তবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাতটি কবরস্থানের মধ্যে উত্তরা ৪ ও ১২ নম্বর সেক্টরের দুটি কবরস্থানে এপ্রিল ও মে মাসের দাফনের সংখ্যার মধ্যে খুব একটা তফাত হয়নি। কবরস্থান দুটিতে এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে তিনটি লাশ বেশি দাফন করা হয়েছে। উত্তরা ৪ নম্বর কবরস্থানে এপ্রিলে ১৯টি এবং মে মাসে ২০টি লাশ দাফন করা হয়। উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর কবরস্থানে এপ্রিলে ২১ এবং মে মাসে ২৩টি লাশ দাফন করা হয়। তবে উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরের কবরস্থানে এপ্রিলে ছয়জনের লাশ দাফন করা হয়। কিন্তু মে মাসে দাফন করা হয়েছে ১২টি লাশ। চলতি মাসের ১৮ দিনে উত্তরা ১২ ও ৪ নম্বর সেক্টরে ১২টি করে লাশ দাফন করা হয়েছে।
বনানী কবরস্থানে এপ্রিল মাসে ৭১টি লাশ দাফন করা হলেও মে মাসে দাফন করা হয়েছে ৯৫টি। মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে এপ্রিল মাসে দাফন করা হয়েছিল ১৫১ জনের লাশ। কিন্তু মে মাসে ২০৮ জনের লাশ কবরস্থ করা হয়েছে। চলতি মাসের গত ১৮ দিনে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়েছে ১৪৪টি।
এদিকে করোনাভাইরাসে মৃতদের রায়েরবাজার কবরস্থানে ৩১ মের আগে দাফন করা হয়নি বলে জানানো হলেও এই কবরস্থানেও মে মাসে আগের মাসের তুলনায় দাফনের সংখ্যা বেড়ে যায়। এপ্রিলে রায়েরবাজারে ১৬৬ জনের লাশ কবরস্থ করা হলেও মে মাসে সেই সংখ্যা ছিল ২৭২টি। এই মাসের গতকাল পর্যন্ত রায়েরবাজারে মোট ৩০০টি লাশ দাফন করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৬০ জন করোনা আক্রান্ত ছিলেন বলে জানা গেছে।
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে কেন হঠাৎ দাফনের সংখ্যা বেড়ে গেল সে ব্যাপারে নানা মত পাওয়া গেছে। কবরস্থানে নিয়ে আসা লাশ দাফনের সময় মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দেখানো বাধ্যতামূলক। তবে বাসায় মারা গেলে স্থানীয় কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র নিয়ে গেলে লাশ দাফনের সুযোগ দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ কাউন্সিলর নিজের প্যাডে ‘স্ট্রোক’, ‘হার্ট অ্যাটাক’ এবং ‘স্বাভাবিক’ লিখে দেন। তবে মে মাসে চিকিৎসাকেন্দ্রের সনদের চেয়ে কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র দেওয়া অনেকটা বেড়েছে কবরস্থানগুলোতে। ফলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ সম্পর্কে জানা যায় না।
ডিএসসিসি ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন লালবাগের ১২৮/২ শহীদনগর দ্বিতীয় গলির বাসিন্দা লাইলী মুন্সী গত ৯ মে মারা যান। তাঁর লাশ আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করার জন্য তাঁর পরিবার ওয়ার্ড কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র নেয়। সেখানে ‘স্বাভাবিক’ মৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করেছেন স্থানীয় কাউন্সিরর। একইভাবে ডিএনসিসি ৩৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছ থেকে একই ধরনের প্রত্যয়নপত্র নিয়ে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয় বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা আছিয়া বেগমকে। মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘বার্ধক্য’ উল্লেখ করেছেন স্থানীয় কাউন্সিলর।
প্রত্যয়নপত্র সম্পর্কে ডিএসসিসির ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. মোকাদ্দেন হোসেন জাহিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কেউ মারা গেলে আশপাশের লোকজনের কাছ থেকে আমরা জেনে প্রত্যয়ন করি। করোনার লক্ষণ নিয়ে দিনে মারা গেলে আমরা নমুনা সংগ্রহ করাই। কিন্তু রাতে মারা গেলে কিছু করার থাকে না।’
হঠাৎ দাফনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া নিয়ে কোনো ধরনের জরিপ বা গবেষণা পরিচালনা করা হয়নি সরকারি কোনো দপ্তর বা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে। ফলে কর্মকর্তারা সুস্পষ্টভাবে কিছু বলতে পারেননি। তবে কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র নিয়ে দাফন করা ব্যক্তিদের মধ্যে অনেক অশনাক্ত করোনা রোগী থাকতে পারেন বলে ধারণা কবরস্থান ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্তদের।
ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মমিনুর রহমান মামুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দাফনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঠিক কারণ বলা কঠিন। তবে এ সময় অনেকে সঠিক চিকিৎসা নিচ্ছেন না বা চিকিৎসার সুযোগ কমে যাওয়া একটা কারণ হতে পারে।’
আজিমপুর কবরস্থানের সহকারী মোহরার মো. নূরুল হুদা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘লাশ নিয়ে এলে কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র দেখে দাফনের অনুমতি দিই। ফলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ আমরাও জানতে পারি না। এত লাশ এর আগে আসত না।’
কবর খোঁড়ার দায়িত্বে থাকা মো. আশিকুর রহমান জুয়েল বলেন, ‘অনেক লাশ আসছে কবরস্থানে। আমি পাঁচ বছরের মধ্যে আগে এত লাশ দেখি নাই। লকডাউন (সাধারণ ছুটি) শুরুর পর থাইক্যা লাশের সংখ্যা বাড়ছে।’ সুত্র-কালের কণ্ঠ