একাত্তরের ডিসেম্বর মাস। মেহেরপুরে তখন কনকনে ঠাণ্ডা। শীতের নীল কুয়াশার চাদর ছিঁড়ে লালবাজার সাবসেক্টরের মুক্তিবাহিনী মেহেরপুরের গ্রামে গ্রামে সমবেত হতে থাকেন। পাক সেনাদের হটিয়ে দিতে তারা মেহেরপুর শহরের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছেন। মর্টার থেকে শেল নিক্ষেপের ফলে পাক সেনারা তখন ভীত সন্ত্রস্ত। মেহেরপুর শহরের পথে পথে মুক্তিকামী জনতা ও ছাত্র-তরুণরা গড়ে তুলেছেন ব্যারিকেড। শত্রুদের প্রতিরোধ ও পরাস্ত করে মেহেরপুর শহরকে মুক্ত করতে হবে, এই তাদের প্রতিজ্ঞা।
আনন্দবাজার পত্রিকায় লিখছে, ‘মেহেরপুর শহর দখল নিয়ে জোর লড়াই চলছে।’ ব্যারিকেড গড়ে তোলার পিছনে যে সকল ছাত্র-যুবক-তরুণঅক্লান্ত শ্রম দিয়েছেন, ঘাম ঝরিয়েছেন তাদের মধ্যে ক্রীড়া সংগঠক, ফুটবলার, সংস্কৃতিসেবী আবদুল হামিদ অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অগ্রজদের কাছ থেকে কাঁচা হাতে বন্দুক-রাইফেল চালানোর ট্রেণিং গ্রহণ করে পাকিস্তনি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার লড়াইয়ে গোপনে সক্রিয় হন।
মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনগুলিতে মেতে ওঠেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কিশোর-তরুণদের সংগঠিত করার কাজে। যে দুরন্ত কিশোর সারাদিন মেতে থাকেন খেলাধূলা নিয়ে, সেই তিনিই রাতের আঁধারে স্কুলের প্রাচীরে, বাড়ির দেয়ালে, দোকানে, চায়ের স্টলে পোস্টার সেঁটে দিতেন স্বাধীনতার পক্ষে। পোস্টারের স্লোগান গুলি কবিতা হয়ে মানুষের মুখে মুখে ফিরতো।কিশোর বয়সেই তার মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক্রীড়াঙ্গনে, ফুটবল মাঠে তিনি নেতৃত্ব দিতেন। পাড়ার ছেলেদের নিয়ে নাটক মঞ্চায়ন, খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনেও নেতৃত্ব দিতেন।
স্বাধীনতার পক্ষে জনমতগড়ে তোলার জন্য বন্ধুদের নিয়ে শহরের অলিগলিতে লিফলেট বিতরণ ও পোস্টারিং করতে একটি গ্রুপ গড়ে তোলেন। একদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী রাজাকারদের মুখের ওপর দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘এদেশ একদিন স্বাধীন হবেই। রাইফেল বেয়োনেট দিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বপ্নগুলো হত্যা করা যাবে না।’ এ কারণে তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহায়তাকারী বিহারী ও পাকসেনাদের চক্ষশূলে পরিণত হন।
অদম্য সাহসী, সংস্কৃতিসেবী ও ক্রীড়া সংগঠক আবদুল হামিদ তখন ছিলেন মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী। চালাক, চটপটে, বুদ্ধিদীপ্ত আবদুল হামিদ লেখাপড়াতেও ভাল ছিলেন। বিপদে-আপদে ছুটে যেতে যেতেন। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। পাড়া-প্রতিবেশীরা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। বয়োস্বল্পতার কারণে স্বাধীনতাযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ না করেও তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হিসেবে সক্রিয়ভাবে কাজ করতেন।
সেদিন ছিল ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখ। সকালটা ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন, কিন্তু দুপুরটা রৌদ্র ঝলমলে। পোস্টারিং ও লিফলেট বিতরণ করে বাড়িতে দুপুরের আহারে বসেছেন আবদুল হামিদ। মা তাঁকে পাশে বসিয়ে খেতে দিয়েছেন, ছোট ভাই আবদুল লতিফ, আবদুল গণি, মনিরুল ইসলাম ও আবদুস সালাম উঠানে খেলাধূলায় মেতে আছেন। মা তাঁর পাতে মাছ, সবজি, ডাল তুলে দিচ্ছেন একে একে, মায়ের তখনও দুপুরের খাবার খাওয়া হননি। হঠাৎশরীফ বিহারীর নেতৃত্বে রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মেহেরপুর শহরের গভর্নমেন্ট হাইস্কুল পাড়ার আব্দুর রশীদের বাড়িতে প্রবেশ করে। মায়ের সামনেই হামিদকে পিছমোড়া করে বেঁধে মেহেরপুর কলেজের পাকিস্তানি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে টানা তিন দিন নির্যাতন করে ৩ ডিসেম্বর রাতে তাঁকে মেহেরপুর কলেজ বধ্যভূমিতে গুলি করে হত্যা করে লাশটি মাটিচাপা দিয়ে পুঁতে রাখে।
শহীদ হামিদের মরদেহটি প্রথম শনাক্ত করেন মা হাদিসা বেগম। কাজী নজরুল শিক্ষা মঞ্জিল প্রাঙ্গণের এক কোণে তাকে সমাহিত করা হয়। কবরটি আজও অবহেলায় অযত্নে পড়ে আছে। স্বাধীনতার পর ৫০ বছর পার হয়েছে, কিন্তু কবরটি আজও পাকাকরণ করা হয়নি।
শহীদ আবদুল হামিদের জন্ম ১৯৫৪ সালে মেহেরপুর শহরের গভর্নমেন্ট হাইস্কুল সংলগ্ন এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বাবা আবদুর রশীদ ব্যবসায়ী, মা হাদিসা বেগম গৃহিণী। বড় মামা মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রব মাস্টার ছিলেন মহকুমা যুবলীগের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বাবা স্বাধীনতার পক্ষে বলিষ্ঠ কর্মী। ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের সুদর্শন এই তরুণ ছিলেন মেধাবী ও অদম্য সাহসী। ভালো ফুটবলার, অ্যাথলেট ও ব্যাডমিন্টনে পারদর্শী। তার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় মেহেরপুর উল্কা স্পোর্টিং ক্লাব।
আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত রফিকুর রশীদের ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: মেহেরপুর জেলা’, অন্বেষা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত তোজাম্মেল আযমের ‘মুজিবনগর: যুদ্ধজয়ের উপাখ্যান’ বইয়ে শহীদ রফিকুল ইসলামকে দেশমাতৃকার সাহসী যোদ্ধা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরের ‘মুক্তিসংগ্রামে মেহেরপুর’ এবং এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ড. হারুণ আর রশিদ সম্পাদিত ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ’ বইয়ে অন্তর্ভূক্ত আবদুল্লাহ আল আমিনের লেখা একটি নিবন্ধে শহীদ হামিদের বীরোচিত আত্মত্যাগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। শহীদ হামিদের স্মৃতি রক্ষার্থে মেহেরপুর শহরের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয় ‘শহীদ হামিদ সড়ক’। কিন্তু এই তরুণ যোদ্ধার কপালে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি জোটেনি ।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও সহযোগী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ, মেহেরপুর।