আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ-যুবলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ, এ সময় অস্ত্র হাতে হামলা করতে দেখা যায়
আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ-যুবলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ, এ সময় অস্ত্র হাতে হামলা করতে দেখা যায়
বৈষমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অসহযোগ আন্দোলন চলছে। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই আন্দোলন ঘিরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ। বেড়েই চলছে নিহতের সংখ্যা। আন্দোলন প্রথম দিন রোববার (৪ আগস্ট) বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ৫২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে নরসিংদীতে ৫ জন, ফেনীতে ৫ জন, সিরাজগঞ্জে ৪ জন, মুন্সিগঞ্জে ৩ জন, রংপুরে ৩ জন, বগুড়ায় ৩ জন, মাগুরায় ৩ জন, ভোলায় ৩ জন, পাবনায় ২ জন, সিলেটে ২ জন, রাজধানী ঢাকায় ২ জন, কুমিল্লায় ১ জন, জয়পুরহাটে ১ জন ও বরিশালে ১ জনসহ ৩৮ জন নিহতসহ আরও অনেকেই।
বিভিন্ন স্থান থেকে নিহতের খবর
পাবনা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনে পাবনায় আওয়ামী লীগ নেতার গুলিতে তিনজন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। রোববার দুপুরে শহরের এ হামিদ রোডের ট্রাফিক মোড়ে বিক্ষোভ চলাকালে এ ঘটনা ঘটে। পাবনা সদর হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. রফিকুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেন। নিহতরা হলো, মহিবুল (১৬), জাহিদ (১৯) ও ফাহিম।
পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, আন্দোলনকারী শিক্ষাথীরা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ঘোষিত কর্মসূচি পালন করছিল। এ সময় পেছন থেকে পাবনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ ও জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শিবলী সাদিক পৃথক হামলা চালায়। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে আওয়ামী লীগ নেতা আবু সাঈদ এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। পুলিশ ধাওয়া দিলে তারা পিছু হটে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
মাগুরা: মাগুরায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাব্বী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। এছাড়া মাগুরার মোহাম্মদপুর উপজেলায় ৪ জন নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
রংপুর: রংপুরে দুপক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছেন। আজ দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রংপুর পায়রা চত্বরে এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন, মাসুম, খায়রুল ইসলাম খসরু, পরশুরাম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও রসিকের ৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হারাধন রায়। এর আগে বেলা ১১টার দিকে শহরজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় দুপক্ষই অবস্থান নেয়।
হাসপাতালের সহকারী পরিচালক সহকারী পরিচালক ডা. রফিকুল ইসলাম জানান, গুলিবিদ্ধ তিনজনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। তাদের মধ্যে দুজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জে শহরের সব রুট দখলে নিয়েছে বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনকারী ছাত্ররা। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে জেলা বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা। এদিকে সংঘর্ষের ঘটনায় শহরের এসএস রোডে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন নিহত হয়েছেন। তারা হলেন, যুবদল নেতা রন্জু (৪০), ছাত্রদল নেতা সুমন (৩০) ও যুবদল কর্মী আব্দুল লতিব (৪২)।
রোববার (৪ আগস্ট) সকাল থেকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে আন্দোলনকারীরা। কয়েক ঘণ্টাব্যাপী ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় শহরের বাজার স্টেশন, এসএস রোড, মুজিব সড়ক, রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষে এক যুবক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে বলে জানা গেছে। তার পরিচয় জানা যায়নি। এ ছাড়া ৭ জন গুলিবিদ্ধসহ ১৪ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
সংঘর্ষের এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা পিছু হটলে পুরো শহর দখল করে নেয় আন্দোলনকারী ছাত্র জনতা। এ সময় তারা ড. জান্নাত আরা হেনরীর বাসা, জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়, সাবেক এমপি হাবিবে মিল্লাত মুন্নার বাসা, আওয়ামী নেতা বিমল কুমার দাসের বাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ছাড়া জেলা জজ আদালত, এসিল্যান্ড অফিস, মুক্তির সোপান স্মৃতিসৌধ, শিল্পকলা একাডেমিসহ শহরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে চয়ন ইসলাম এমপির বাসা ভাঙচুর করা হয়। বেলকুচি ও উল্লাপাড়া আওয়ামী লীগ অফিসে আগুন দেওয়া হয়।
সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যার বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ডা. রতন কুমার জানান, এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ১৪ জন ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৭ জন গুলিবিদ্ধ। সদর থানার ওসির সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমরা তিনজন নিহতের খবর শুনেছি। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারিনি।
বরিশাল: বরিশালে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের বাড়িতে হামলার সময় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আ.লীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় আন্দোলনকারীদের হামলায় মহানগর ১২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি টুটুল চৌধুরী নিহত হয়েছেন। পরে আন্দোলকারী প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের বাড়ির সামনে ১১টি মোটরসাইকেলে আগুন দিয়েছে।
ভোলা: ভোলার নতুন বাজারে আইনশৃঙ্খলনা রক্ষাকারী বাহিনী গুলিতে তিনজন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে জসিম উদ্দিন (৭০) নামে একজন ছাতা শ্রমিকের পরিচয় জানা গেলেও দুইজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাদের বয়স ২০ থেকে ২২ বছর বলে জানা গেছে। রোববার দুপুর ১টার দিকে এ ঘটনা ঘটেছে।
এ সময় আন্দোলনকারীদের হামলায় দুই পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হয়েছেন। পরে আন্দোলনকারীরা আ.লীগ অফিস, শ্রমিক লীগ অফিস ও পৌরসভা ভাঙচুর চালিয়ে দুটি গাড়িতে আগুন দেয়। এ সময় ডিসি অফিসের দুটি গাড়িতেও আগুন দেয় তারা।
বগুড়া: বগুড়ায় অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় একজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। রোববার বগুড়ার সাতমাথায় এ হতাহতের ঘটনা ঘটে।
জয়পুরহাট: জয়পুরহাটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অসহযাগ আন্দোলনের প্রথম দিনে দফায় দফায় সংঘর্ষে মেহেদী হাসান নামে একজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় কমপক্ষে ৭০ জন আহতের খবর পাওয়া গেছে। আহতদের জয়পুরহাট ২৫০ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রোববার দুপুরে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে।
ফেনী: ফেনীতে অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থকদের সঙ্গে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষে পাঁচ আন্দোলনকারী নিহত হয়েছেন। রোববার দুপুর ২টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী মহিপাল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। তাৎক্ষণিকভাবে নিহতদের নাম ও পরিচয় জানা যায়নি। ফেনী ২৫০ শয্যা জেলারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আসিফ ইকবাল কালবেলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ ৫৬ জন
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, আজ বিকেল তিনটা পর্যন্ত রাজধানীর শাহবাগ, শনির আখড়া, নয়াবাজার, ধানমন্ডি, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, পল্টন, প্রেসক্লাব এবং মুন্সিগঞ্জ থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ৫৬ জনকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
আগামীকাল থেকে তিনদিনের সাধারণ ছুটি
চলমান অবস্থায় আগামীকাল সোমবার (৫ আগস্ট) থেকে তিনদিনের জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। আজ রোববার নির্বাহী আদেশে এ ছুটি ঘোষণা করা হয়।
উল্লেখ্য, সরকার পতনের এক দফা দাবিতে আজ রোববার থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন চলছে। গতকাল শনিবার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষোভ সমাবেশে অসহযোগ আন্দোলনের রূপরেখা তুলে ধরেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। এর আগে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রোববার থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হাজার হাজার মানুষের সমাবেশে এই ঘোষণা দেয়া হয়। এই সমাবেশেই অসহযোগ আন্দোলনের রূপরেখা তুলে ধরা হয়।
সূত্র: ইত্তেফাক