সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীরা ব্যাপক হারে ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ায় বিরক্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কারণ, সরকারের অনুমোদন ছাড়াই তাঁরা ব্যবসায় জড়াচ্ছেন, যা সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বেতন–ভাতা বাড়ানোর পরও সরকারি চাকরিজীবীদের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের। ব্যবসা করার ক্ষেত্রে নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেন না কর্মকর্তা–কর্মচারীরা। যেসব কর্মকর্তা–কর্মচারী ব্যবসায় জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ ধরনের একটি চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমডি) সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী।
এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, কিছু কিছু সরকারি কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা সরকারের অনুমোদন ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, যা সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯–এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিধিমালার ১৭ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের অনুমোদন ছাড়া, সরকারি কাজ ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসায় জড়িত হতে পারবেন না। অন্য কোনো চাকরি বা কাজ গ্রহণ করতে পারবেন না। পরিবারের সদস্য অর্থাৎ স্ত্রী–সন্তানও ব্যবসা করতে পারবেন না।
আমরা সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ব্যবসায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছি। অনুমোদন ছাড়া যাঁরা ব্যবসা করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, সেটি ঠিক হবে না।
শেখ ইউসুফ হারুন, জনপ্রশাসনসচিব
তবে একজন নন–গেজেটেড সরকারি কর্মচারী অনুমোদন ছাড়া তাঁর পরিবারের সদস্যদের শ্রমকাজে লাগিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালাতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে সম্পত্তির ঘোষণাপত্রের সঙ্গে ব্যবসার বিস্তারিত বিবরণ দাখিল করতে হবে।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব শেখ ইউসুফ হারুন সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের অনুমোদন ছাড়া যে ব্যবসা করা যাবে না, সেটি সব কর্মকর্তা-কর্মচারী জানেন। তারপরও তাঁরা বিধিমালা মানছেন না। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আইনের কথা ভুলে যান। তাঁদের আইনের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যবসায় জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি সামনে আসে গত বছর দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময়। জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জারি ইউনিটের রেজিস্ট্রার ডা. সাবরিনা চৌধুরী জেকেজি নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। একজন সরকারি চাকরিজীবী হয়ে তিনি অনুমোদন ছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার শারমিন জাহান একজন সরকারি চাকরিজীবী হয়েও মাস্ক সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শুধু এই দুজনই নন, অন্যান্য ব্যবসায়ও সম্পৃক্ত হচ্ছেন সরকারি চাকরিজীবীরা।
বিধিমালার ১৭ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের অনুমোদন ছাড়া, সরকারি কাজ ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসায় জড়িত হতে পারবেন না। অন্য কোনো চাকরি বা কাজ গ্রহণ করতে পারবেন না। পরিবারের সদস্য অর্থাৎ স্ত্রী–সন্তানও ব্যবসা করতে পারবেন না।
সরকারি কর্মকর্তারা কী ধরনের ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছেন, তা জানতে এই প্রতিবেদকের কথা হয় প্রশাসনের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার পাঁচজন কর্মকর্তার সঙ্গে। তাঁরা বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে কোম্পানির পরিচালক পদে যুক্ত হওয়ার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। সরকারি পদে থেকে তাঁরা অন্য প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হয়ে যাচ্ছেন। প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হয়ে সরকারের অনুমোদন ছাড়া তাঁরা মালিক বনে যাচ্ছেন। অনেকে গাড়ি কিনে সে গাড়ি ভাড়ায় দিচ্ছেন। কেউ কেউ জমি ও ফ্ল্যাট কেনাবেচায় জড়িয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হচ্ছেন। কেউ কেউ ফার্ম করে পেছনে থেকে সরকারি দপ্তরের কাজ বাগিয়ে নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসনসচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘আমরা সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ব্যবসায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছি। অনুমোদন ছাড়া যাঁরা ব্যবসা করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, সেটি ঠিক হবে না।’
এদিকে ২০১৯ সালে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আজ পর্যন্ত কার্যকর করতে পারেনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী, সরকারের কাছে প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদ বিবরণী দাখিল করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিলেও কিছুসংখ্যক কর্মকর্তার বাধার মুখে সেটি কার্যকর হয়নি।
জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার সাংবাদিককে বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যবসা করার খবর আগে শোনা যেত না। ইদানীং বেশ শোনা যাচ্ছে। কর্মকর্তাদের ব্যবসা বন্ধ করা উচিত। যাঁরা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যবসায় জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি মেনে নেওয়ার মতো নয়। কারণ, এটি একদিকে আইনের লঙ্ঘন, অন্যদিকে স্বার্থের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।
সূত্র-প্রথম আলো