হাকালুকি হাওড়ের জলাবদ্ধতা নিরসনে ফানাই নদী খননের উদ্যোগ নেয় সরকার। নদীটি খননে ১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু বরাদ্দ টাকার অর্ধেকই জলে গেছে। কার্যাদেশ অনুযায়ী কোথাও কাজ হয়নি। ফলে হাওড়পারের কয়েক লাখ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। একাধিকবার অভিযোগ জানানো হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমলে নেয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তদারকির অভাব এবং কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো নামকাওয়াস্তে কাজ করে ৫০ শতাংশ টাকা উত্তোলন করেছে।
জেলা পাউবোর কর্মকর্তারা জানান, হাওড়পারের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ফানাই নদী খনন প্রকল্প হাতে নেয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। ৪০ কিলোমিটার খননে প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে (ভাটি অংশ) হাকালুকি হাওড়ের চকিয়া বিল থেকে ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের কাকিচার গ্রাম পর্যন্ত সাড়ে ২৩ কিলোমিটার খনন ও নদীর দু’পাশ ড্রেজিং করে জলজ বৃক্ষ রোপণে ৭ কোটি ৭৪ লাখ ১৯ হাজার ১৬ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ঢাকার মেসার্স মা-বাবা কন্সট্রাকশন ও শরিফ অ্যান্ড সন্স ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি পায়। উজান অংশে ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের কাকিচার থেকে কর্মধা ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকা মহিষমারা পর্যন্ত সাড়ে ১৬ কিলোমিটারের খননে ৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এসএএসআই অ্যান্ড ইশতাত এন্টারপ্রাইজ ও জুয়েল জয়েন্ট ভেঞ্চার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি পায়।
ভাটি অংশে প্রকল্পের কাজ ২০১৯ সালে শুরু হয়ে চলতি বছরের মার্চে শেষ হয়। তবে প্রকল্পের ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ কাজ হয়েছে। ইতোমধ্যে ৫০ শতাংশ টাকা উত্তোলন করেছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। উজান অংশে প্রকল্পের কাজ আগামী নভেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ কাজ হয়েছে। ৪০ শতাংশ টাকা উত্তোলন করেছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
সরেজমিন হাকালুকি হাওড়ে দেখা যায়-হাওড়ের দুগাঙ্গা পয়েন্ট (চালিয়া) থেকে ফানাই নদীর নিচের অংশের খনন কাজ নামকাওয়াস্তে করা হয়েছে। খননযন্ত্রের দ্বারা নদীর দুই পাশ থেকে কিছু মাটি উত্তোলন করে নদীপারেই ফেলে রাখা হয়েছে। এতে কৃষক, মৎসজীবী, পর্যটকসহ সর্বস্তরের মানুষ যাতায়াতে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে গত বোরো মৌসুমের ধান বাড়িতে তুলতে কৃষকদের দুর্ভোগের অন্ত ছিল না। আবার কোথাও কোথাও ফসলি জমিতেই মাটি ফেলে রাখা হয়েছে। এদিকে পুরো নদী খনন না করায় নৌকা চলাচলেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। আবার নদীর অনেক অংশে খননই করা হয়নি। ভাটি অংশে ৯ হাজার ৪০০ জলজ বৃক্ষ রোপণের কথা থাকলেও সরেজমিনে একটি গাছও চোখে পড়েনি। ফানাই নদীর জাব্দা, ছিলারকান্দি, ছকাপন, কাদিপুর, চুনঘর ও খাকিচার অংশেও একই অবস্থা।
ভুকশিমইল ইউনিয়নের রিয়াজুর রহমান বলেন, নদীর দু’পারে মাটি স্তূপ করে রাখা হয়েছে। ফলে মাটি ফের নদীতে এবং পার্শ্ববর্তী ফসলি জমিতে পড়ে যাচ্ছে। এতে করে সাধারণ কৃষকরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আবার এলোমেলো করে মাটি রাখায় সাধারণ মানুষের যাতায়াতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তিনি আরও বলেন, নদী পারের কোথায়ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। যার কারণে চাষাবাদের মৌসুমে জলাবদ্ধতা লেগেই থাকে। কাজের গাফিলতির কারণে এত টাকা খরচ করেও প্রধানমন্ত্রীর এ বিশেষ প্রকল্প মানুষের কোনো কাজে আসছে না। হাওড় পারের কৃষক আজমল মিয়া, বশির মিয়া, আব্দুল বারী, খালেদ আহমদ, জয়নাল মিয়া ও মতলিব মিয়া বলেন, অগোছালোভাবে মাটি ফেলে রাখায় যাতায়াতে সমস্যা হয়। গবাদিপশু কিংবা কৃষিপণ্য নিয়ে আমরা হাওড়ে নামতে পারি না। নদীর পুরো অংশ (প্রস্থ) খনন না করায় নৌকা চলাচলে বাধাগ্রস্ত হয়। হাকালুকি হাওড় তীরবর্তী কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির বলেন, ফানাই নদীর অনেক স্থান আছে খননই করা হয়নি। কিন্তু প্রকল্প মেয়াদ শেষ। একাধিকবার তাদের বলার পরেও কথাগুলো আমলে নেয়নি। তিনি বলেন, একজন জনপ্রতিনিধি হিসাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমার দাবি কার্যাদেশ অনুযায়ী কাজ করা হোক।
মেসার্স মা-বাবা কন্সট্রাকশনের প্রোপ্রাইটর হাসান মোল্লা বলেন, কার্যাদেশ অনুযায়ী মোটামুটি কাজ করার চেষ্টা করেছি। কোথাও মাটি কম আবার কোথাও মাটি বেশি থাকার কারণে কিছু ত্রুটি থাকতে পারে। মৌলভীবাজার পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তারুজ্জামান বলেন, কাজ অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে টাকা দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের কাজ দেখভাল করার জন্য অফিসের দু’জন দায়িত্ব পালন করেছেন। এখানে দুর্নীতি করার কোনো সুযোগ নেই।