গত বছরের ১০ ডিসেম্বর বর্তমান সরকারের পতন ঘটবে, আর বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলবে এমন গুজব ছড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব ছিল দলটি। সাধারণ মানুষের মনেও অজানা আতঙ্ক বিরাজ করেছিল- কী যেন হয় ১০ ডিসেম্বর। আবারও সেই পথে হাঁটছে সেনা ছাউনি থেকে থেকে জন্ম নেওয়া দলটি। এবার তারা এমাসেই অর্থাৎ অক্টোবরেই বর্তমান সরকারের পতন ঘটবে বলে দেশবাসীকে বিশ্বাস করাতে চাইছে।
নভেম্বরের শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এর আগেই চূড়ান্ত আন্দোলনে দফারফায় পৌঁছাতে চায় বিএনপি। এজন্য অক্টোবরে রাজপথেই ফয়সালা করতে চায় বিএনপি, এবং সেটা রাজপথেই। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে, ফয়সালা বলতে আদতে কি চায় বিএনপি?
কয়েক সপ্তাহ ধরে বর্তমান সরকার পতনের একদফা দাবিতে সরব হয় বিএনপি। কিন্তু এর মাঝে খালেদা জিয়ার মুক্তি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিসহ বিভিন্ন দাবিতে বিভিন্ন সময় আন্দোলন করছে। দাবি ও দফার ক্ষেত্রে বিএনপ স্পষ্ট করতে পারেনি যে তাদের দফা আসলে কয়টি। কখনও ৩১ দফা, কখনও ১০ দফা, এরপর এখন একদফার আন্দোলনেও একই অবস্থা। সর্বশেষ দলীয় প্রধান খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করার ষড়যন্ত্রে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিল গত ২৪ সেপ্টেম্বর। ৪৮ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও বিএনপি কিছুই করতে পারেনি। আল্টিমেটাম শেষ হওয়ার পর দলের মহাসচিব আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্তের কথা জানাবেন বলেছিলেন। অর্থাৎ, আল্টিমেটামের মধ্যে কাজ না হলে কি করা হবে সেই সিদ্ধান্তই তাদের ছিলনা। ফলে কোনো আন্দোলনেই জনসম্পৃক্ততা পায়নি দলটি। সিদ্ধান্তহীনতা, নেতাকর্মীদের মধ্যে ঐক্যের অভাব, সমন্বয়হীনতার কারণে কোনো আন্দোলনেই যেমন দৃশ্যমান সফলতা আসেনি। তেমনি বারবার দলের নেতাকর্মীদেরকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করা হলেও তা ব্যর্থ হয়েছে।
২০১১ সালে খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছিলেন সরকারের বিরুদ্ধে ঈদের পরে তীব্র আন্দোলন হবে, সে বছর ঈদ এসেছিল ঠিকই কিন্তু জনসমর্থন না পেয়ে আন্দোলন করতে পারেনি বিএনপি। একইভাবে ২০১২, ২০১৩, ২০১৪ সালেও ঈদের পরে তীব্র আন্দোলন ঘোষণা করেছিলেন খালেদা জিয়া। প্রতিবছর ঈদ এলেও খালেদা জিয়ার সেই আন্দোলন আর আসেনি। বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান ২০২২ সালে ঘোষণা করেছিলেন ১০ ডিসেম্বরের পর খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলবে। গেল ১০ ডিসেম্বর, কিন্তু ঈদের পর আন্দোলনের মতোই আবারও শুভংকরের ফাঁকি দিলো বিএনপির আন্দোলন।
বিএনপির চলমান কর্মসূচি শেষ হবে ৫ অক্টোবর। এরপর পরবর্তী ধাপের আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া হবে। তাদের পরিকল্পনা সেই আন্দোলন ২০ তারিখ পর্যন্ত চালানোর পর ২৪ তারিখের থেকে চূড়ান্ত কর্মসূচি দেওয়া হবে। দলটির এমন বিশ্রাম-বিরতি দিয়ে আন্দোলন করার প্রবণতায় বেজায় নাখোজ তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
এজন্য দলের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নেতা আন্দোলনে নিষ্ক্রিয়তা দেখাচ্ছেন, যারা সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন তাদের মাঝেও উৎসাহের অভাব দেখা যাচ্ছে। অনেককেই তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিতেও দেখা যাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক জানান, দলটির নেতা কে? প্রতি মুহূর্তে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছ থেকে। চেয়ারপারসেন খালেদা জিয়া বর্তমানে সাজাপ্রাপ্ত আসামি এবং শারীরিকভাবে রাজনীতি করতে অক্ষম। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও ফেরারি আসামি হয়ে দেশের বাইরে। মহাসচিবসহ অন্য নেতারাও ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত নেন। একারণে আন্দোলন কর্মসূচিতে ঠিকমতো সমন্বয় হচ্ছে না। এই সুযোগটি নিচ্ছে সরকারি দল।
বিএনপি নেতাদের মধ্যে কোনো সমন্বয়হীনতা নেই বলে দাবি করেছেন দলটির মহাসচি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার পতনের আন্দোলনে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এই লড়াইয়ে সবাইকে থাকতে হবে এবং এই সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের র্যা বের ওপর স্যাংশন এবং ভিসানীতির কারণে সরকার কিছুটা চাপে আছে বলে মনে করে বিএনপি। এজন্য মাঠের আন্দোলনের চেয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপে দিকে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা অপেক্ষায় আছে বিএনপি নেতৃত্ব।
রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার মনে করেন, বিএনপি বিগত এক বছর ধরে যে আন্দোলন চালিয়ে আসছে তাতে তাদের দাবি আদায় বা লক্ষ্য পূরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, ‘বিএনপি বিদেশি চাপের কথা বলে ও ষড়যন্ত্র করে যে চাপ দিতে চাইছে তাতে আওয়ামী লীগ বিচলিত নয়। এ অবস্থায় যদি সমঝোতার কথা সামনে আসে, তাহলে প্রশ্ন হলো, সমঝোতা হবে কোন বিষয়ে?, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি উচ্চ আদালতের আদেশে বাতিল হয়েছে। অর্থাৎ, ২০১৮ সালের মতো বিদ্যমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা ছাড়া কোনো সমঝোতার পথ বিএনপির সামনে খোলা নেই।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুভাষ সিংহ রায় বলেন, ‘সব বিষয়ে জনসমর্থন হারিয়ে দিশেহারা বিএনপি আন্দোলনের নামে খালি কলশি বাজিয়ে যাচ্ছে। নিজের ঘর গুছিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার মতো প্রস্তুতি দলটির নেই। প্রধান বিরোধীদল হিসেবে দাবি করলেও এখন দলটির অবস্থান অত্যন্ত নড়বরে। অক্টোবরেই ফয়সালা করার মতো সক্ষমতা দলটির নেই। যেকোনো উপায়ে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছে দলটি।’