অনলাইন জুয়ার শীর্ষ এজেন্ট শামিম রেজা ওরফে শামিমকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে মেহেরপুর চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ।
গত ১১ অক্টোবর উচ্চ আদালতের ডিভিশন বেঞ্চের বিচারক বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো: খায়রুল আলম এ আদেশ দেন। একই সঙ্গে এই ৬ সপ্তাহের মধ্যে তাকে গ্রেফতার বা হয়রানি না করার জন্য পুলিশকেও নির্দেশ দিয়ে অন্তবর্তীকালীন জামিন দিয়েছেন আদালত।
শামিম রেজা গ্রেফতার এড়াতে গত ১১ অক্টোবর উচ্চ আদালতের আইনজীবী গোপাল চন্দ্রর মাধ্যমে জামিন আবেদন করেন।
শামিম রেজা মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুর গ্রামের বিলু সর্দারের বড় ছেলে। তিনি রাশিয়ান ভিত্তিক অনলাইন জুয়া সাইট লাইন বেটের মাস্টার এজেন্ট।
এর আগে চলতি বছরের ২৫ আগস্ট শামিম রেজার বিরুদ্ধে অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ৩০(২)/৩৫ ধারায় মুজিবনগর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন মেহেরপুর পুলিশের সাইবার অপরাধ বিভাগ। মামলায় শামিমসহ আরো ১৫ জনকে আসামি করা হয়।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন-গোপালপুর গ্রামের আমিরুল ইসলামের ছেলে শিশির বিশ্বাস, নুরুপুরের বিল্লাল গড়াইয়ের ছেলে দিপু, কোমরপুর গ্রামের আনারুল মিয়ার ছেলে রুবেল, টঙ্গীর শরিফের ছেলে মো: পলাশ, মুজিবনগরের শিবপুরের মৃত শাহাজুলের ছেলে বিজয়, একই গ্রামের জিনারুলের ছেলে লিপু গাজী, মোনাখালী গ্রামের আজহারুলের ছেলে মিলন, সাইদুর রহমান খোকনের ছেলে সাগর, কোমরপুর গ্রামের বাশার বিশ্বাসের ছেলে সজীব, ভাটপাড়া গ্রামের মৃত সিরাজ মণ্ডলের ছেলে বাবু, মেহেরপুর শহরের স্টেডিয়াম পাড়ার বখতিয়ার মাস্টারের ছেলে রুবেল, গাংনীর গাড়াডোব গ্রামের মৃত কিয়াম উদ্দিনের ছেলে আনোয়ার।
গত ১৩ অক্টোবর মেহেরপুর প্রতিদিনে ‘অনলাইন জুয়ার শীর্ষ এজেন্ট শামিম অধরা’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
জানা গেছে, তিন বছর আগে বাবার ছোট রাইস মিল চালিয়ে কোনমতে সংসার চালাতেন শামিম রেজা। হঠাৎ করে আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়ে বনে গেলেন কোটিপতি। কোটি টাকা খরচ করে গড়ে তুলেছেন হার্ডওয়ার ব্যবসা। যেভাবে পাইলিং দিয়ে ভবন তৈরি করছেন তাতেও খরচ হচ্ছে কোটি টাকার উপরে। ছোট ভাইকে রাজধানীর একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। মোটরসাইকেলে নতুন মডেল আসলেও সেটি হতে হয় শামিম ও তার ছোট ভাই সোহাগ রানার জন্য। বর্তমানে দুই ভাই দুটি ইয়ামাহা ব্র্যাণ্ডের আরওয়ানফাইভ মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন। এলাকাতে কয়েক বিঘা জমিও কিনেছেন।
বর্তমানে তিনি কক্সবাজারের ফাইভ স্টার হোটেল ‘সাইমান’ এ অবস্থান করছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। উচ্চ আদালত থেকে ৬ সপ্তাহের অন্তবর্তীকালীন জামিন পেয়ে ফুরফুরে মেজাজে সময় কাটাচ্ছেন। সাথে আছেন তার শিষ্য দিলিপ হালদারসহ কয়েকজন এজেন্ট। বর্তমানে কত টাকার মালিক তিনি তা কেউ জানে না। তার ছোট ভাই সোহাগ রানা মাঝে মাঝেই বিভিন্ন দেশে ঘুরতে যান। আর সকল কিছুই এসেছে অনলাইন জুয়ার দৌলতে। অনলাইন জুয়ার মাস্টার এজেন্ট হিসেবে যে কয়জন রয়েছেন শামিম রেজা তাদের একজন। তিনি নিজেই চালান একাধিক এজেন্ট চ্যানেল। খবর রয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তিনি এগুলো পরিচালনা করছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শামিম রেজা করোনার প্রথম দিকে ওয়ান এক্স বেটে কাজ করলেও পরবর্তিতে রাশিয়ান কোম্পানী লাইনবেট কোম্পানীর সাথে যোগাযোগ করে একাই শুরু করেন অনলাইন জুয়ার ব্যবসা। কয়েকটি এজেন্ট নিয়ে কাজে লাগান বেশ কয়েকজন যুবককে। তার এজেন্ট হিসেবে কাজ করে ইতোমধ্যে পুলিশের কাছে আটক হয়েছে নিমাই হালদার, প্রসেনজিৎ হালদার, সুমন আলী ও সুমন নামের চার যুবক। নিমাই হালদার, সুমন আলী ও সুমন আদালতে শামিম রেজার হয়ে কাজ করেন বলে স্বাকারোক্তিও দিয়েছেন। প্রসেনজিৎ হালদার আদালতে স্বীকারোক্তী না দিলেও অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত একাধিক সূত্র তাকে শামিমের এজেন্ট বলে নিশ্চিত করেছেন।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, শামিম রেজা এজেন্ট হয়ে কাজ করেন তার ছোট ভাই সোহাগ রানা, নিমাই হালদারের চাচাত ভাই দিলিপ হালদার, কোমরপুর গ্রামের আজিবার আলীর ছেলে শিপলু রানা, কুদ্দুস আলীর ছেলে আকাশ আলী। তবে অনলাইন জুয়ার সংবাদ প্রকাশ হওয়া ও পুলিশের অভিযান শুরু হলে সকলেই এলাকা থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এজাহার থেকে জানা গেছে, শামিম রেজা পুলিশের এজাহার ভুক্ত অনলাইন জুয়ার অন্যতম আসামি। মামলার প্রধান আসামি বদুরুদ্দোজা রয়েলকে আটকের পর তার স্বীকারোক্তীতে শামিম রেজাসহ আরো ১৫ জনের নাম করে পুলিশের কাছে।
শুধ শামিম রেজা নয়, “অনলাইন জুয়ার দূর্গ” ক্যাটাগরি নিয়ে মেহেরপুর প্রতিদিন ধারাবাহিকভাবে অনলাইন জুয়ার সাথে মাস্টার এজেন্টদের (রাঘববোয়াল) কার্যক্রম নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে আসছে। সংবাদে ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক অনলাইন জুয়ার নাম ও পরিচয় উঠে এসেছে। ক্রমান্বয়ে বাকিদের অনলাইন জুয়ার কার্যক্রম নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হবে। যার অংশ হিসেবে মেহেরপুর প্রতিদিনের অনুসন্ধান অব্যহত রয়েছে। মেহেরপুর প্রতিদিনে ধারাবাহিকভাবে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার কারণে উঠেপড়ে লেগেছে পুলিশ প্রশাসন। এছাড়ার সরকারের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অনলাইজ জুয়ারিদের নজরদারিতে রেখেছে বলে মেহেরপুর প্রতিদিনের কাছে সংবাদ রয়েছে।
জানা গেছে, বিট কয়েন বা ডিজিটাল মুদ্রার (ক্রিপ্টোকারেন্সি) মাধ্যমে অনলাইনে জুয়া খেলা হয়। অবৈধ পন্থায় ডিজিটাল মুদ্রা কেনাবেচার লেনদেনে দুই বছরে বছরে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে অনুমান করছে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে এই টাকা পাচার হয়েছে বলে জানান সংস্থ্যাগুলো। আর অনলাইন জুয়ার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুর গ্রাম। যে গ্রাম থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে পুরো দেশকে।
রাশিয়া থেকে পরিচালিত এসব অনলাইন জুয়ার সাইট ও অ্যাপস তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে মেহেরপুর জেলা শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যায়ে । এসব জুয়ার সাইট ও অ্যাপস ভার্চুয়ালি জুয়া খেলায় একেকটি এজেন্টের মাধ্যমে মাসে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
এর মধ্যে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টেগেশন সেল ইতোমধ্যে ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে। ইতোমধ্যে জেলার অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত জুয়াড়িদের একটি তালিকাও প্রস্তুত করেছে পুলিশ। অনলাইন জুয়া বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও তারা কাজ শুরু করেছেন।
পুলিশের একটি সুত্রটি জানায়, মেহেরপুর জেলার অনলাইন জুয়ার এই চক্রটির মাধ্যমে প্রতিমাসে ৩৮০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। সে হিসেবে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে। যেটি অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে যাচ্ছে বিদেশে।
জানা গেছে, মেহেরপুর জেলা থেকে দুই শতাধিক এজেন্ট অনলাইন জুয়া সাইটের মাধ্যমে রাশিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করছেন প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। আর এই অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত মেহেরপুরের সরকার দলীয় কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের কয়েকজন শীর্ষ নেতা, স্কুল ও কলেজের কয়েকজন শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেনীর প্রায় দুই শতাধিক ব্যক্তি।
পড়ুন ধরাছোঁয়ার বাইরে অনলাইন জুয়ার অন্যতম চার হোতা মুকুল-জামান-নুরুল-মাদার
কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা, কিছু রাজনৈতিক নেতা এবং কয়েকজন সাংবাদিক নিয়মিত মাসোহারা নেন অনলাইন জুয়াড় সাথে জড়িত ছিলেন এজেন্টদের সাথে। তাদের মাসোহারা দিয়ে দেদারছে জুয়া খেলে কোটি বনে যাচ্ছেন এসব এজেন্টরা। আর পথে বসছেন হাজার হাজার তরুণসহ জুয়া খেলার জড়িত ব্যক্তিরা। মেহেরপুর প্রতিদিনের অনুসন্ধানীতে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তবে মেহেরপুর প্রতিদিনে ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশের পর তাদের মাসোহারা বন্ধ হয়ে গেছে। তাদেরও কপালেও দুশ্চিন্তার ভাঁজ দেখা দিয়েছে।
পড়ুন মেহেরপুরে অনলাইন জুয়ার আরেক এজেন্ট সাদ্দাম আটক
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সঠিক নজরদারি না থাকায় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রতিদিনই কোটি টাকা পাচার হচ্ছে দেশের বাহিরে। এতে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি বিপথে যাচ্ছেন তরুণ ও যুবকরা। এক মাসে একটি সিম (এজেন্ট) থেকে লেনদেন হচ্ছে কোটি টাকার উপরে। জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টেগেশন সেল যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে ইতোমধ্যে মুজিবনগর উপজেলার কয়েকজনকে আটক করে তাদের স্বীকারোক্তিতে এসব তথ্য জানতে পেরেছে।
পড়ুন মেহেরপুরে অনলাইন জুয়ার মাস্টারমাইণ্ড প্রসেনজিৎ সহযোগীসহ আটক
অনলাইন জুয়া নিয়ে মেহেরপুর প্রতিদিনের অনুসন্ধানি টিমের অনুসন্ধানে নতুন নতুন এজেন্টদের খবর পাওয়া যাচ্ছে। রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়া এসব অনলাইন জুয়ার হোতাদের দৌরাত্মে নি:স্ব হচ্ছে বহু তরুণ। খুব সহজেই অঢেল টাকার মালিক বনে যাওয়ায় তারা কাউকেও পরোয়া করছেন না। এখনো যারা ধরা পড়েননি বা যাদের নাম সংবাদে আসেননি তারা বুক ফুলিয়ে অনলাইন জুয়ার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে অনলাইন জুয়ার আদ্যপান্ত জানতে মেহেরপুর প্রতিদিননের সঙ্গেই থাকুন। ধারাবাহিকভাবে মেহেরপুর প্রতিদিন পাঠকদের সামনে অনলাইন জুয়ার সংবাদ তুলে ধরা হবে।( চলবে…)