বাউল সম্রাট ফকির লালনের ১৩২তম তিরোধান দিবস উপলক্ষ্যে শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপী আলোচনা, সংগীতানুষ্ঠান ও লালন মেলা।
দমানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ শ্লোগান নিয়ে আজ সোমবার (১৭ অক্টোবর) থেকে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়িতে শুরু হচ্ছে এ লালন মেলা। ১৯ অক্টোবর শেষ হবে এ অনুষ্ঠানের। তবে এর আগেই মনের টানে চলে এসেছেন সাধু-বাউল-ভক্তরা। লালনের গানে গানে প্রচার করছেন তার মানব দর্শনের। গুরু-শিষ্যর মিলনের এই ক্ষণ যতটা দীর্ঘ করা যায় সেই লক্ষ্যে অনুষ্ঠান শুরুর আগেই চলে আসেন তারা।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় কুষ্টিয়া লালন একাডেমির আয়োজনে এ তিরোধান দিবস পালন উপলক্ষে আখড়া বাড়িতে সকল প্রস্তুতি শেষ করা হয়েছে।
সত্য ও সু-পথের সন্ধানে মানবতার দীক্ষা নিতে ইতোমধ্যেই আত্মার টানে দেশ-বিদেশের সাধুগুরু ও ভক্তরা দলে দলে এসে আসন গেড়েছেন সাঁইজির (লালন শাহ) মাজারে। মূল উৎসব শুরু হওয়ার আগেই আখড়ায় আসা বাউল সাধকরা মাজারের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে গেয়ে চলেছেন সাঁইজির আধ্যাত্মিক মর্মবাণী। কুষ্টিয়া পরিণত হয়েছে উৎসবের শহরে।
সোমবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ এমপি তিনদিন ব্যাপী লালন মেলার উদ্বোধন করবেন।
তিরোধান দিবস উপলক্ষে লালন শাহের মাজার প্রাঙ্গনে বসেছে সাধুদের হাট। কালিগঙ্গার ভরাট জায়গায় হরেক রকমের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসছেন ব্যবসায়ীরা। মেলায় থাকছে মুড়ি, মুড়কি, বাতাসা, জিলাপিসহ নাগরদোলা ও আসবাবপত্রের দোকান।
আখড়াবাড়ি চত্বর ও আশে পাশে লালন ভক্তরা আসন গেঁড়ে বসেছেন। তাদের মুখে মুখে সাঁইজির বাণী। লালন একাডেমির শিল্পী শিরীন আক্তার বলেন, ‘লালনের গান বিভিন্নভাবে ও মিউজিক দিয়েও গাওয়া হচ্ছে। লালনের প্রকৃত সুর ধরে রাখার চেষ্টা করছি।’
তিনদিন ধরে লালনের গানের আধ্যাত্মিকতা তুলে ধরা হবে তার সুরেই। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর (পহেলা কার্তিক) লালনের মৃত্যুর পর থেকে তাঁর ভক্তরা এ ধারা অব্যাহত রেখেছে।
প্রতিবছরই লালনের তিরোধান দিবসে বাউলভক্ত সাধু-গুরুরা আখড়াবাড়িতে চলে আসে কয়েকদিন আগেই। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। লালনের জাতহীন মানবধর্মে দীক্ষিত হয়ে তার জীবনকর্ম, ধর্ম-দর্শন, মরমি সংগীত ও চিন্তা-চেতনা থেকে শিক্ষা নিতে দাওয়াতপত্র ছাড়াই দিনক্ষণ ঠিক রেখে এবারও সাঁইজির ধামে ছুটে এসেছে ভক্ত, অনুসারী, দর্শনার্থীরা।
লালন একাডেমির সভাপতি ও কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম জানান, ফকির লালন শাহের তিরোধান দিবস উপলক্ষে এবার তিন দিনব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই প্রায় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।’
কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার খায়রুল আলম জানান, সুষ্ঠুভাবে আয়োজন সম্পন্ন করতে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি অনুষ্ঠানস্থলে থাকছে র্যাব ও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ।
লালন একাডেমির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সেলিম হক বলেন, ‘ফকির লালন জীবদ্দশায় দোল পূর্ণিমায় সাধু-ফকিরদের একত্রিত করে উৎসব করতেন। দিনরাত গান আর গুরু-শিষ্যের পরম্পরা চলত। ২০০ বছরের সেই রেওয়াজ এখনো আছে। এর সঙ্গে ১৩২ বছর ধরে তিরোধান দিবস পালন করা হচ্ছে। এটিও একই আদলে।
সাঁইজির বারামখানায় বসেছে ভবের হাট। ‘এসব আয়োজনে কোনো দাওয়াতের দরকার হয় না, দিনক্ষণ ঠিক রেখে আগেই সাঁইজির বারামখানায় চলে আসেন দেশ-বিদেশের সাধু-বাউল-ভক্তরা। বছরে দুটি বড় উৎসবের মাধ্যমে লালনের অসাম্প্রদায়িক দর্শন বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে।’
ছেঁউড়িয়া লালন মাজারের খাদেম মহম্মদ আলী শাহ জানান, সাঁইজির তিরোধান দিবসে এ সময় আখড়াবাড়ি দেশ-বিদেশ থেকে আগত লাখো প্রাণের পদভারে মুখরিত হয়ে ওঠে। প্রতিবছরের মতো এবারেও লালন ভক্তদের জন্য বিকালে অদিবাস, সকালে বাল্যসেবা ও দুপুরে পূর্ণসেবা ব্যবস্থা রয়েছে।
উল্লেখ্য, বৃটিশ শাসকগোষ্ঠির নির্মম অত্যাচার গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনকে যখন বিষিয়ে তুলেছিল, ঠিক সেই সময় সত্যের পথ ধরে, মানুষগুরুর দীক্ষা দিতেই সেদিন মানবতার পথ প্রদর্শক হিসাবে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের আবির্ভাব ঘটে কুমারখালির ছেঁউড়িয়াতে। লালনের জন্মস্থান নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকলেও আজও অজানায় রয়ে গেছে তার জন্ম রহস্য।
লালন ছিলেন নিঃসন্তান। আর্থিক অসংগতির কারণে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। তবে তিনি ছিলেন স্বশিক্ষায় শিক্ষিত। তিনি প্রায় এক হাজার গান রচনা করে গেছেন। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর ভোরে এই মরমী সাধক বাউল সম্রাট দেহত্যাগ করেন এবং তাঁর সাধন-ভজনের ঘরেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।