আজ ২৩ অক্টোবর। স্থানীয় শহীদ রোভার দিবস। মেহেরপুরের জন্য শোকের দিন। ১৯৯৭ সালের আজকের এই দিন। সকাল হতেই এক মর্মান্তিক খবরে জেলাব্যাপী শোকের ছায়া নেমে আসে। সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগান সংলগ্ন গলফ ক্লাব অ্যারিনায় ৯ম এশিয়া প্যাসিফিক/৭ম বাংলাদেশ রোভার মুটে অংশ নিতে মেহেরপুর থেকে ছেড়ে রোভার স্কাউটের বাসটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। আর এতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হোন ৫ রোভার। আহত আরো ১৯ জন।
কভার রোভাররা হলেন জাভেদ ওসমান, মনিরুল ইসলাম, মাসুম হোসেন, মুন্সী আমিনুল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাহফুজ। তাঁদের মধ্যে জাভেদ ওসমান, মনিরুল ইসলাম ও মাসুম হোসেন ছিলেন মেহেরপুর শহরের। আমিনুল ইসলামের বাড়ি মুজিবনগরের দারিয়াপুর এবং মাহফুজুর রহমান ছিলেন সদর উপজেলার উজুলপুর গ্রামের।
বাংলাদেশ স্কাউটের ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘রোভার’ এপ্রিল সংখ্যার মূল প্রতিবেদন ছিল মেহেরপুরে শহীদ রোভারদের নিয়ে। “ডেডলাইন মেহেরপুর” শিরোনামে সেই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২৪ অক্টোবর থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগান সংলগ্ন গলফ ক্লাব অ্যারিনায় অনুষ্ঠিত ৯ম এশিয়া প্যাসিফিক/৭ম বাংলাদেশ রোভার মুটে যোগদানের জন্য মেহেরপুর জেলার মেহেরপুর সরকারী কলেজ, মুজিবনগর কলেজ, মুন্সী মেহেরুল্লাহ মুক্ত রোভার স্কাউট গ্রুপ, মুন্সী জমির উদ্দীন মুক্ত রোভার দলের ৩২ জন রোভার স্কাউট ও ৪ জন রোভার লীডার (শিক্ষক) সহ ৩৬ জন একটি ভাড়াকৃত বাসযোগে (বাস নং-মেহেরপুর জ- ০৪-০০১৫) ২২ অক্টোবর রাত ৮ টার সময় মেহেরপুর থেকে যাত্রা শুরু করে। বাসটি গত ২৩ অক্টোবর ভোরর ৫টা ১০ মিনিটে ঢাকার অদূরে ধামরাই থানাধীন জয়পাড়া নামক স্থানে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় পতিতহয়। দুর্ঘটনাস্থলে ৫জন রোভার স্কাউটের মৃত্যু ঘটে। এছাড়া ১৯জন রোভার আহত হয়।
তার মধ্যে ১৭ জনকে ধামরাই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। একজনকে তাৎক্ষণিকভাবে ধামরাই থানা কমপ্লেক্স ভর্তি করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় মেহেরপুর সরকারী কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র রোভার ফারুক হোসেনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশ স্কাউটস এর প্রধান জাতীয় কমিশনার জনাব মনযূর উল করীম বিষয়টি স্বরাষ্ট্র সচিব মহোদয়কে অবহিত করেন। তিনি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, জেলা প্রশাসক, ঢাকা এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপাধ্যক্ষের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করেন। এছাড়া তিনি মেহেরপুর জেলা প্রশাসকের সাথে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে আলোচনা করেন।
মনযূর উল করীম দুর্ঘটনার সংবাদটি সাথে সাথেই রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি ও চীফ স্কাউট বিচারপতিসাহাবুদ্দীন আহমদ, বৃটেন সফররত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া শোক প্রকাশ করেন এবং শোকবার্তা প্রেরণ করেন।
বাংলাদেশ স্কাউটসের উদ্যোগে দুর্ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের আ্যাম্বুলেন্স এবং পিকআপ ভ্যান প্রেরণ করা হয়। নিহত ৫জন রোভারের মৃতদেহ প্রথমে বাংলাদেশ স্কাউসের জাতীয় সদর দফতরে আনা হয়। এরপর মৃতদেহগুলি পোস্টমর্টেমের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় । বাংলাদেশ স্কাউটসের প্রধান জাতীয় কমিশনার-এর ব্যক্তিগত চেষ্টায় অল্প সময়ের মধ্যেই মৃতদেহগুলি পোস্টমর্টেম, গোছল। ইত্যাদি সমাধা করে কফিনে রাখা হয়। এই সকল কাজের তদারকি করেন বাংলাদেশ স্কাউটসের প্রধান জাতীয় কমিশনার জনাব মনযূর উল করীম, রোভার অঞ্চলের — আঞ্চলিক উপ-কমিশনার (প্রশাসন) জনাব নির্মল কান্তি মিত্র, আঞ্চলিক উপ-কমিশনার (গবেষণা ও মূল্যায়ন) প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুস সালাম, জাতীয় উপ-কমিশনার (সমাজ উন্নয়ন) জনাব মিহির কান্তি মজুমদার।
কফিন তৈরীর হওয়ার পর তা মরহুমদের আত্মীয়গণের নিকট হস্তান্তরের জন্য ফায়ার সার্ভিসের পিকআপ ভ্যান যোগে মেহেরপুর জেলা রোভার স্কাউটসের সভাপতি এবং জেলা প্রশাসকের নিকট প্রেরণ করা হয়। বাংলাদেশ স্কাউটসের ব্যবস্থাপনায় একটি বাস ও একটি মাইক্রোবাসে করে অন্য সকল রোভার ও মেহেরপুর থেকে আগত আত্মীয়-স্বজনদেরকে মেহেরপুওে প্রেরণ করা হয়। বাসের সাথে বাংলাদেশ স্কাউটসের ২ জন।
কর্মচারীকে মাইক্রোবাস যোগে প্রেরণ করা হয়। প্রধান জাতীয় কমিশনার মহোদয়ের অনুরোধক্রমে মৃতদেহগুলি জেলা প্রশাসনের সিনিয়র কর্মকর্তার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অভিভাবকের নিকট হস্তান্তর করা হয়। পরদিন ২৪ অক্টোবর ৯৭ তারিখ শুক্রবার মেহেরপুর সরকারী কলেজ মাঠে তাঁদের নামাজের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। নামাজে জানাজায় প্রায় ২০ হাজার স্থানীয় লোক শরীক হন।
জাতীয় প্রচার মাধ্যম ও পত্র-পত্রিকায় দুর্ঘটনার বিষয়টি ফলাও ভাবে প্রকাশিত হয়। ২৫শে অক্টোবর ১৯৯৭ তারিখে ৯ম এশিয়া প্যাসিফিক/৭ম বাংলাদেশ রোভার মুটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দিন রাষ্ট্রপতি ও চীফ স্কাউট বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ-এর উপস্থিতিতে এক ভাবগম্ভীর পরিবেশে শোকবার্তা পাঠ করা হয় ও নিহতদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়।